বনবিবির পালাগান || পর্ব – ১৬

দীপা ব্রহ্ম

মালঙ্গি, মৌলে, বাউলে, নৌজীবী, শিকারী নামগুলির সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের বাঙালিরা কোনো না কোনোভাবে পরিচিত। দক্ষিণবঙ্গে সর্ববৃহৎ দ্বীপ সুন্দরবনকে ঘিরে এ নামগুলি বারবারই আবর্তিত হয়। নোনতা জলের চড়া স্বাদ, খাড়ির অপ্রসস্থ জল বিভাজিকা, ম্যানগ্রোডের শেকড়ের নানা কারুকাজ আর পাল্লা দিয়ে সুন্দরী, গেঁওয়া, গরাণ, হেতালের চাপট বন। কী এক কুহকিনী মায়া রানি। বাঙালি সব সময়ই ছুটে গেছে এই নিরাপত্তাহীন বন্যতার স্বাদ নিতে। কত কত দ্বীপ, কত কত নাম, কত কত সবুজ-হলুদ-বাদামি রঙের গাছ। এই জল জঙ্গলেও তো মানুষ আছে। তাদের নিজেদের মতো করে বাস করার জায়গা আছে। আর বেঁচে থাকার পরিচ্ছন্ন বাতাস বুক ভরে, প্রাণ ভরে নিতে আছে তাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি। এই অঞ্চলের গা ছম ছম পরিবেশের সঙ্গে মাখামাখি করে ম্যানগ্রোভের শিকড়গুলির মতোই মাটি আঁকড়ে রয়েছে যেনো।

কথা হলো এই অঞ্চলে বসবাসকারী বাবলু মণ্ডলের সঙ্গে যিনি বনবিবি পালা করেন। পৌষ মাসের শেষ ও মাঘের পয়লায় বনবিবির পুজো হয়। ওই দিনই বনবিবি পালাও হয় সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন জায়গাগুলিতে। তাঁর কথায় জানলাম, গোটা পালার নানা উপাখ্যান করতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা।
বাবলু মণ্ডল বাস করেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার সজনেখালির কাছেই একটি প্রত্যন্ত জঙ্গল-ঘেরা গ্রামে। পাশে বয়ে গেছে নদী পাথর। গ্রামের নাম অ্যানপুর। বাবলুবাবুর বনবিবি পালার দলের নাম সুন্দরবন সংস্থা। গ্রামের এ পালায় অভিনয় করেন। বাবলুবাবু বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি। কারণ ছোটো বয়সেই তাঁকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। কারণটা খুবই করুণ। তিনি যখন খুবই ছোটো, নদীতে মীন বাগদা ধরতে গিয়ে কুমিরের কামড়ে মারা গেছেন তাঁর মা। নিঃসঙ্গ বাবার পাশে ওই বয়সেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এমনই প্রতিকূলতায় থেকেই তিনি বা তাঁর দল সুদুর মুম্বাই পাড়ি দিয়েছেন। সেখানে বনবিবির পালা শর্টফিল্ম হিসাবে ক্যামেরা বন্দি হয়েছে। বনবিবির পুজো হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই করেন। তবে দেবী উভয় সম্প্রদায়ের কাছে ভিন্ন রূপে পূজিত হন। কোথাও বনবিবির গায়ের রং হলুদ, কোথাও তাঁর কোলে থাকে ছোট্ট শিশু, দেবী বাঘে অধিষ্ঠিত। কোথাও দেবীকে মুকুট পরতে দেখা যায়, কখনো ঘাঘরা, মাথায় লতাপাতা আঁকা টুপি, পায়ে মোজা গায়ে নানা গয়নাগাটিও থাকে।

বাবলুবাবুর মুখে শুনলাম বনবিবি পালার গল্পগাথা। ধোনা-মোনা দুই ভাই ও তাদের গ্রামতুতো ভাই দুখে বনে যায় মধু, মোম সংগ্রহে। দুখে খুবই দুখি। তাই ছোটো অবস্থাতেই তাকে বনে যেতে হয় রোজগারের ধান্ধায়। এদিকে বনে গিয়ে ধোনা দক্ষিণ রায়কে পুজো করতে ভুলে যায়। রেগে গিয়ে ধোনাকে দক্ষিণ রায় স্বপ্ন দিলেন। তাঁর সন্তুষ্টি হবে তখনই যখন ধোনা তাঁকে নরমাংস দেবে। এও বললেন নরমাংস বিনা তাঁর বন থেকে ধোনা মোম, মধু কিছুতেই নিতে সক্ষম হবে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধোনা দুখেকে দক্ষিণ রায়ের কাছে রেখে বন ছাড়ল ও গ্রামে গিয়ে রটিয়ে দিল দুখেকে বাঘে খেয়েছে। দুখের মা এই মৃত্যু সংবাদে খুব ভেঙে পড়ল। ওদিকে বনের মধ্যে দুখে দক্ষিণ রায়ের মুখোমুখি হয়ে তিন বার মা বলে চিৎকার করে। বনবিবি এই ডাকে চমকে ওঠেন ও তৎক্ষণাৎ দুখেকে উদ্ধারের জন্যে তাঁর ভাই শা জঙ্গলীকে সঙ্গে নিয়ে দুখের রক্ষায় এগিয়ে আসেন। শা জঙ্গলী দক্ষিণরায়কে বিতাড়িত করে দুখেকে রক্ষা করেন। বনবিবির দয়ায় দুখে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়। দুখে একটি কুমিরের পিঠে চেপে গ্রামে ফিরে আসে। মৃত ছেলেকে ফিরে পেয়ে দুখের মায়ের আনন্দ আর ধরে না। দুখে গ্রামে ফিরে বনবিবির পুজো শুরু করে।

এই মিথ থেকেই জঙ্গল ও সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষ বনবিবিকে পুজো করেন। বাবলুবাবু জানালেন, এই সম্পূর্ণ গল্পটি পালা হিসেবে তাঁরা এখন করেন না। কারণ এই পালা করতে প্রায় ২৫ জন অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রয়োজন; প্রয়োজন গায়ক, বাদকের। কিন্তু পালা-প্রদর্শনী হিসেবে এত পরিমাণে অর্থ তাঁরা পান না যে তা দিয়ে যথেষ্ট সংখ্যক শিল্পীকে সাম্মানিক দিতে পারেন। তাই পালা ছোটো করে, কম অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে তাঁরা পালা করেন। সুন্দরবনের টুরিস্ট লজে, টুরিস্টদের আনন্দ দিতে তাঁর দল বনবিবি পালা দেখান। নানা পোশাক, মেকআপে তাঁরা নিজেদের সাজান। তবে ঠিকঠাকভাবে জীবনধারণ করতে পাশাপাশি কৃষিকাজ করতে হয় তাঁকে। একই ছবি তাঁর দলের অন্য সদস্যদের।

তিনি বললেন, বনবিবি একজন লৌকিক দেবী। সন্দেশখালি, দক্ষিণ রায়পুর, কালিনগর ইত্যাদি অঞ্চলে তাঁরা বনবিবির পালা দেখাতে যান। বনবিবির পালা এ অঞ্চলে অন্য নামেও পরিচিত আছে। দুখের যাত্রা, জরুরনামা, বনবিবির যাত্রা ইত্যাদি। আগে এ পালায় হারমোনিয়ামের ব্যবহার বেশি হলেও এখন ক্যাসিও সে জায়গাটি নিয়েছে। বাবলুবাবুর দলের ও তাঁর নিজের লোকশিল্পী কার্ড আছে। ফলে সরকারি প্রোগ্রাম তাঁরা পান। এছাড়াও সরকারি লোকশিল্পী ভাতা তিনি পান। আমরা নাগরিক মানুষজন হাত বাড়ালেই মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের সঙ্গে মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক প্রযুক্তির নানা সুবিধা ভোগ করি। কেউ বলি অর্থের জোগান নেই বলে নাচ বা গান বা নাটক এখন আর করতে পারছি না, চাকরিটাই করছি, কেউ আবার এর সঙ্গে যুক্ত থেকে নানা স্যাক্রিফাইসের গল্পও বলি বন্ধু মহলে। সবটাই খাঁটি, সবই সত্যি। কিন্তু তবু আমাদের মাথার ওপর একটা ছাদ আছে। রাত-বিরেতে ঘর থেকে বেরুলে বাঘে কুমিরে নেবে না। আজকের ডিজিটালাইজেশনের যুগে ওই বন-বাদাড়ের মানুষগুলি কীভাবে শুধু জীবনটাকে বাজি রেখে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে, পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে, পেটের খিদেয় গিট দিয়ে সংস্কৃতিচর্চা করে যাচ্ছেন, সে বড়োই অদ্ভূত। ‘রোটি-কাপড়া অউর মঞ্চান’—জীবনের এই তিন নিশানের প্রাধান্য তাঁদের কাছে গৌণ। ফুৎকারে উবে যায়। বেঁচে থাকে বিশ্বাস, লড়াই আর আপন মনে চলার স্বাধীনতা। সুন্দরী বনমাতার মতোই।

756 thoughts on “বনবিবির পালাগান || পর্ব – ১৬

  1. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ নিরন্তর করে চলেছেন থিয়েটারে লোকশিল্প বিষয় নিয়ে বিশিষ্ট অভিনেত্রী লোকশিল্পী দীপা ব্রহ্মদিদি। আগামী পর্বে আর কোন ফর্ম আসছে অপেক্ষায় রইলাম।

Comments are closed.