থিয়েটারের জন্য লড়াই চলছে অভিনেত্রী স্বাগতার

বিজয়কুমার দাস 

স্বাগতাকে জীবনে বড় হতে হয়েছে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে। কিন্তু অদম্য জেদ আর নিষ্ঠাকে সম্বল করে সে থিয়েটারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। মালদা থেকে কলকাতায় এসে থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার যে লড়াই শুরু করেছিল সেই লড়াইএর জোরেই অভিনেত্রী হিসাবে নিজের জাত চিনিয়েছে স্বাগতা সেন।

মালদায় জন্ম। বাবা সুশান্ত সেন, মালদহ এয়ারপোর্টে চাকরি করতেন। মালদহ ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিতে সবেমাত্র শুরু হয়েছিল লেখাপড়া। কিন্তু মালদহ এয়ারপোর্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংসারে বিপর্যয়। স্বাগতা তখন তিন বছরের শিশু। মালদহ থেকে পুরো পরিবারকে চলে আসতে হলো পৈতৃক ভিটে হাওড়া জেলার আমতায়। বাবা রইলেন ব্যক্তিগত ব্যবসার কাজে আসামে। মা পূর্ণিমা সেন একটা চাকরি করতেন। স্বাগতার শৈশব কেটেছে একা, বদ্ধ ঘরে। প্রাথমিক পড়ার পর্ব শেষে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির পরীক্ষায় কৃতিত্ব দেখিয়ে আমতা গার্লস হাইস্কুলে সরাসরি ভর্তির সুযোগ মেলে। রঙবেরঙের প্রজাপতি, হরেক রকম পাখি, ছেলেবেলার দুষ্টুমির মধ্যেই সঙ্গীতশিল্পী মায়ের কাছে সঙ্গীত শিক্ষায় হাতেখড়ি। মা গান শিখেছিলেন সাগর সেনের কাছে। ঝোঁক বাড়ে নাচের প্রতি। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবার, ঘরের বাইরে নাচ শিখতে যাওয়া সম্ভব নয়। বাবা আসামবাসী।

মাধ্যমিক শেষে একাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ঠিক পরেই দূরদর্শনে মিসফিট রিয়ালিটি শো তে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো এবং বিজয়ী হিসাবে পুরস্কার যাওয়া স্বাগতার।
২০১১ তে শুরু হলো কলকাতায় বসবাস। সিকিম মণিপাল ইউনিভার্সিটিতে বি বি এ পড়ার জন্য ভর্তি। গান শেখা শুরু এবার মহাশ্বেতা ব্যানার্জীর কাছে। আর ছোটবেলা থেকে লালন করা নাচ শেখার ইচ্ছা পূরণ হলো একটানা দু’ বছর ( ২০১১-১৩) চান্দ্রেয়ী ঘোষের কাছে রবীন্দ্রনৃত্য শিখে। সেই সময়েই “বান্ধবী” রিয়ালিটি শোতে যোগ দিয়ে সাফল্য এবং ২০১৪ সালে বিবিএ স্নাতক। ব্রেনওয়ার ইন্সটিটিউটে বাবার ইচ্ছায় ভর্তি হতে গিয়ে সুযোগ মিলে যায় চাকরি করার। অন্যদিকে মা বাবার শারীরিক অসুস্থতা এবং নিজেরও সাময়িক অসুস্থতায় নেমে আসে বিপর্যয়। তবু ফিনান্সে ভর্তি হয় সে। সেই সময়েই(২০১৫) থিয়েটারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায় তার।

কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সূত্রে পরিচিত বন্ধু সৈকত চক্রবর্তীর যোগাযোগে যাদবপুর স্পন্দন দলের প্রতিষ্ঠা ও সেই দলে যোগদান।একসময় বাবার সঙ্গে কলকাতার বিভিন্ন হলে থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতা ছিল। হয়তো তখন থেকেই থিয়েটারের প্রতি একটা গোপন প্রেম গড়ে উঠেছিল। সৈকত চক্রবর্তীর রচনা ও নির্দেশনায় “সত্বা”নাটকের মধ্যে দিয়ে স্বাগতা যোগেশ মাইমে অভিনেত্রী হিসাবে রঙ্গমঞ্চে অভিষিক্তা হলো। আবার মা বাবার অসুস্থতা। আবার বিপর্যয়। পাশে এসে দাঁড়ালেন বান্ধবী তনুশ্রী। সেই পরিস্থিতিতেই এমবিএ উত্তীর্ণ। বাবা সুশান্ত সেন পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়ার সমস্যায় শয্যাশায়ী হলেন। বাবার ব্যবসায় লকআউটের কালো ছায়া গাঢ় হলো। সংসারের প্রয়োজনে ফিনান্স কোম্পানীতে চাকরি নিতে হয় তাকে।

২০১৭ তে আবার থিয়েটারে ফিরল স্বাগতা। তার আগে ২০১৬ তে যাদবপুর স্পন্দনের ” “সীতাভোগ” নাটকে সীতার চরিত্রে অভিনয় করে নজর কেড়েছিল অনেকের। আলোকপর্ণা গুহের কাছে নৃত্যের প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে পুষ্পক নাট্যদলে যোগ দেয় সে। এই দলের “রাখো হরি আল্লা রাক্ষা ” এবং যাদবপুর স্পন্দনের আফতাব, চারের খোঁজে, মৃত রিপু নাটকে অভিনয় করে থিয়েটারের লড়াইএ শক্ত মাটি পায় স্বাগতা। ২০১৮তে প্রতিভাবান শিল্পী দেবরূপ সেনগুপ্তের সঙ্গে বিয়ে হয়। চলতে থাকে থিয়েটার যাপন।

এবার কসবা অর্ঘ্যর “কঙ্ক ও লীলা ” নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি প্রবীর গুহর অলটারনেটিভ লিভিং থিয়েটার, বিধাননগর মেধা দলে অনিরুদ্ধ কুণ্ডুর কাছে প্রশিক্ষণ তাকে সমৃদ্ধ করে। পুষ্পকের এ হি কেশাভা, তাসের দেশের নাগরিক এর পাশাপাশি এবার রাজডাঙা দ্যোতক দলে যুক্ত হয় সে। দ্যোতকের সাদা ঘোড়া নাটকের প্রস্তুতিতে বেহালা ব্রাত্যজনের কাঞ্চন আমিন নির্দেশিত “তারপর একদিন “নাটকে অভিনয় করে। কলকাতা সাউথ সাইন, ছত্রছায়া, গ্রীণ পার্ক অভিযান দলেও অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়, আর্য সেনগুপ্ত, প্রদীপ ভট্টাচার্য, পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় অভিনয় করেছে বিভিন্ন নাটকে।
এর বাইরে দাদাগিরিতে অংশ নিয়ে বিজিত সম্মান সহ বিভিন্ন ওয়েব সিরিজ, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, বিভিন্ন চ্যানেলে ধারাবাহিক এবং ভ্রমণ বিষয়ক ফটো ফিচারে কাজ করে চলে অনবরত।

কিন্তু থিয়েটারই তার প্রাণভোমরা। দীর্ঘদিনের নাট্যচর্চায় বহু কঠিন চরিত্রে অভিনয় করে থিয়েটারের জগতে নিজের জায়গা করে নিয়েছে লড়াকু অভিনেত্রী স্বাগতা সেন। এই লড়াই এর মধ্যে থাকাটাই তার কাছে অন্তহীন আনন্দ।