আমরা টিকিটের লাইনে রাজা | অভি চক্রবর্তী

রাজা এভাবে চলে যাওয়া যে ঠিক হয়নি তা এখন আপনি হাড়ে হাড়ে বুঝছেন নিশ্চয়ই, উপর থেকে গোটা ধরিত্রীকে দেখতে দেখতে…আপনার মেয়ে, আপনার স্ত্রী আপনাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যা আপনি দেখছেন কিন্তু আপনি নিরুপায়। তাদের ডাকের যে উত্তর আপনি দিচ্ছেন, তা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে আপনারই জিম্মায়। এমন এক সুক্ষস্তরে আপনি চলে গেছেন যে কোনো স্পট লাইটের তেজেই আপনি আর প্রতীয়মান হবেননা। কোনো সহ- অভিনেতাই আপনাকে আর গ্রাহ্য করবেনা, সকলেই শুধু আপনার জন্য স্মরণকাব্য লিখে চলেছি আমরা? এটা কি ঠিক হলো বলুন তো?

এমনিতেই আপনি করতেন মফস্বল থিয়েটার। আমাদের মতোই ঘুরে ঘুরে। যেসব মঞ্চে আলোর সঠিক কোণ খুঁজে পাওয়া বিলাসিতা, আলো জ্বলা মানেই লটারি পাবার উচ্ছ্বাস আপনার মুখে চোখে মেখে থাকতো, আমাদের মতোই। সেখানে আপনি এই ছুই ছুই চল্লিশে বিদায় নিলেন। রাজা ঘাতক লরি যখন ছুটে আসছিল, আসছিল আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে একবারও কী টের পেয়েছিলেন যে জীবন এমন ক্ষণিকের! হাসি ঠাট্টা তামাশা আবার ঈর্ষা রাগ দ্বেষ সবই মানুষের বিলাস সঙ্গী। আমি জানি আপনার মুখে যে সারল্যের হাসি খেলা করে চলতো অবিরল, যে সারল্য আজ সমাজ থেকে ছেড়ে চলে গেছে সেই সারল্যমাখা মুখ এবং বেঁচে থাকাকেই জীবন বলে ধরে নিয়েছিলেন আপনি। অথচ বিধাতা ভেবেছিলেন অন্যকিছু আপনার মতো সিসিফাসের উত্তরাধিকারকে হয়তো তিনি আর বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেন না। চারিদিকের তোলপাড় করা অন্যায়, তছনছ হয়ে যাওয়া সামজিক শৃঙ্খলা, ছিন্নভিন্ন হয়ে আসা মানবিক মূল্যবোধের এই ঝকঝকে পৃথিবীর স্পটলাইট থেকে বিধাতা আপনাকে কেড়ে নিয়ে চলে গেল। হয়তো বা নতুন কোনো স্পেসের সন্ধান দেবেন তিনি আপনাকে। স্বর্গে বা এমন কোনো সুক্ষস্তরে যেখানে আপনাকে বিভূতিভূষণের সঙ্গে দেবযানের নাট্যরূপ দিতে হবে, আপনি সেখানে ভয়ে ভয়ে ঢুকে দেখবেন সূর্যালোকের সময়কালকে কীভাবে এই সুক্ষস্তরে এনে ফেলা যায় তা নিয়ে তাপস সেন একের পর এক পরিকল্পনা করে চলেছেন, এই সুক্ষস্তরে কীভাবে উচ্চারণ হবে সংলাপ, কীভাবেই তা পৌঁছে যেতে পারে দেবতাদের নাটমন্দিরে তা নিয়ে উদয়াস্ত মাথার চুল ছিঁড়ছেন স্বয়ং শাঁওলি মিত্র আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ঘুরে ঘুরে আবৃত্তি করছেন, বিড়বিড় করছেন পাট। আপনার নিজেকে খানিক অপাঙতেয় লাগতে পারে, যেমনটা বেঁচে থাকাকালীন এই থিয়েটারে লাগত। শহরের থিয়েটার কবেই বা আপনাকে সাদরে বরণ করেছে বলুন? আমাদের কাকেই বা কবে করেছে? আপনার মাথায় তো সেটা গেঁথে গ্যাছে। এমনভাবে গেঁথেছে যে পোস্টমর্টেমের কাটাছেঁড়ার পরেও তা বিদায় নেয়নি। ভাগের দাগ স্পষ্ট হয়ে আছে। তাই জানেন তো আপনার স্মরনকাব্য তো দূর অস্ত সামান্য কয়েক লাইনও কোথাও প্রকাশিত হবেনা, আপনার জন্য দু চারকথা বলবার লোকও আস্তে আস্তে ভুলে যাবে, কারণ তাদের কাছে কোনো ডাক আসবেনা…আপনি যে প্রান্তের কারিগর ছিলেন, পরিধি ঘেঁষে থাকা জীবন আপনার কিন্তু এইসব সুক্ষস্তরে দেখুন তেমন কোনো ভাগ নেই। আমি নিশ্চিত আপনি ওখানে দারুণ কেতাবী ঢং এ অলৌকিক উচ্চারণে এবং আপনার যৌবনের দুরন্ত উচ্ছ্বাসে বলীয়ান হয়ে ‘সে ও বিকর্ণ’ করতে পারবেন, পারবনই। বিধাতা হয়তো এই স্পেসটুকু আপনাকে দিতে চেয়েছিল, তাই আমাদের কাদিয়ে আপনাকে নিয়ে গেল, এক অনন্ত স্তরে এক অমোঘ অভিনয়ের জন্য…

চিন্তা করবেননা। আমরাও টিকিটের লাইনে আছি। আমি দীপক দা, সুমন দা, পার্থ দা, রাহুল দা থেকে আরো অনেক অনেক মানুষ…

চলুন থার্ড বেল পড়ে গ্যাছে, আলো নিভে এল। আকস্মিক জ্বলে ওঠা অন্ধকারে চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার।