শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র | পর্ব – ১১

কমল সাহা 

সেপ্টেম্বর’৫০ 

নবান্ন নিয়ে অনেক হয়েছে, আর নয়। হাতে র‌ইলো পথিক আর উলুখাগড়া। দুটি বিন্দু জুড়লে একটি সরলরেখা। আরো একটি করা দরকার। ত্রিকোণ জমির‌ও একটা ক্ষেত্রফল আছে, দাঁড়াবার মতন একটু জায়গা আছে — তিন বিন্দু জুড়ে একটা ত্রিকোণ নাট্যসম্ভার নিয়ে করা যেতে পারে নাট্য উৎসব। নাটক চাই, ভালো নাটক। এই মুহূর্তে আরো একটা নাটক দরকার। ভাবছিলেন শম্ভু মিত্র।
ঠিক এইরকম সময়ে একদিন মহলাকক্ষে গল্প করছিলেন তুলসী লাহিড়ী। রংপুরে তাঁর নিজের চোখে দেখা দুর্ভিক্ষের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এক মুঠো চালের বিনিময়ে স্বামী বিক্রি করে দিচ্ছে বৌকে … বাচ্চা বিক্রি করে দিচ্ছে মা … নিজের কন্যাকে পাঠাচ্ছে অসহায় মানুষ যৌনকর্মে লিপ্ত করার জন্য ক্ষুধার তাড়নায়। চতুর্দিকে হাহাকার। ফ্যান দাও ফ্যান দাও … মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগুলির যেন অভিনয় হয়ে চলেছে প্রতিদিনের জীবননাট্যে ! পঞ্চাশের মন্বন্তরে মারা গেছে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে … হাত পা শুকনো হতে হতে কংকাল শরীর! মানুষের এতো বড়ো সর্বনাশ করেছে মানুষ‌ই — বিপন্ন বাংলার গ্রাম আজো কেঁপে ওঠে সেদিনের দুঃস্বপ্নে।
এই তো, এই তো পেয়ে গেছি। আপনি নিয়েই নাটক লিখুন। দারুণ জমবে — বলে ওঠেন শম্ভু মিত্র। নবান্নের গন্ধ থাকুক, গণনাট্যের স্পর্শ থাকুক আবার এটা হয়ে উঠুক সময়ের দলিল।
তুলসীবাবুর দ্বিধা — কেউ আবার এতে সাম্প্রদায়িকতার ক্লেশ খুঁজে পাবে না তো? শুরু হবে না তো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ?
তৃপ্তি মিত্র উৎসাহ দিলেন : যে যাই বলুক, আপনি লিখুন। প্রাণ ঢেলে লিখুন।

রচিত হলো ছিন্নতার। বাহে আঞ্চলিক উপভাষায় সংলাপ। হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই। স্বার্থপর মানুষের আদিম ষড়যন্ত্র। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ, খাদ্যসংকট সব কিছুর সঙ্গে লড়াই করে জিতলে পারে একটা মানুষ — পায় না শুধু ধর্মের শোষণ থেকে পরিত্রাণ!

শম্ভু মিত্র নামটা পাল্টে ছেঁড়াতার করলেন। শুরু হলো মহলা। পূর্ণ উদ্যমে, নতুন আনন্দে, মেতে উঠলো বহুরূপী। তুলসীবাবু দ্বিতীয়বার।

প্রথম কল শো 

বহুরূপীর ছোট্ট জীবনে প্রথমবার কল শো এলো কাটোয়া থেকে। আইডিয়াল ক্লাবের সাহায্যার্থে ২৪.১০.১৯৫০ পথিক এবং ২৫.১০.১৯৫০ উলুখাগড়া। কলকাতার পত্র পত্রিকা পথিকের প্রশংসা করলেও এ নাটকটি নিন্দিত হয়েছে কম্যুনিস্টদের দ্বারা। এটি প্রতিক্রিয়াশীল নাটক। আর উলুখাগড়া তো শ্যামবাজারের শোভন সংকরণ। কোনো বক্তব্য‌ই নেই সে নাটকে।

স্থানীয় অঞ্জলি পত্রিকায় এই দুটি নাটক সম্পর্কেই লেখা হয়েছে ২.১১.১৯৫০ তে। তাঁদের মতে পথিক প্রতি গ্রামে-গ্রামে অভিনীত হ‌ওয়া দরকার — এতে জনশিক্ষার অনেক উপাদান আছে। কিন্তু উলুখাগড়ায় ক্ষুদ্র অংশের আভ্যন্তরীণ ব্যভিচারের চিত্র লোক শিক্ষার পরিবর্তে বিপরীত ফলে পরিণত হবে।

মফস্বলের ক্ষুদ্র একটি পত্রিকা এতো বড়ো একটা অভিমত দিয়ে বসেছে শম্ভু মিত্র মহাশয়কে। যিনি গণনাট্যের জন্মলগ্নের নায়ক তাঁকে বোঝানো হচ্ছে কোনটা লোকশিক্ষার পক্ষে ভালো, কোনটা মন্দ! এই শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথকেও চেনেন — নিবারণ পণ্ডিতকেও জানেন — গ্রামশহরের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। নানারকম মানুষকে ইনি মুগ্ধ করেছেন মধু বংশীর গলি শুনিয়ে।

উলুখাগড়ায় শচীনবাবু খুঁজে পেয়েছিলেন চিরকালের এক মাকে। গ্রামের মা আর শহরের মা এক‌ইরকম। এক‌ইরকম এই মায়েদের মর্মকথা। কিন্তু বঙ্গের মাতৃ প্রতিমা রাশিয়ান মাদারের থেকে আলাদা। সেখানে ঘটে গেছে বিরাট একটা যুদ্ধ ও বিপ্লব — শুরু হয়ে গেছে যন্ত্রদানবের উৎকট আয়োজন-আক্রমণ … প্রাকৃতিক মাধুর্যে বেড়ে ওঠা আমাদের মধ্যবিত্ত সংসারের মা কখনোই শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী কিংবা কলে কারখানায় খেটে খাওয়া মানুষের মা হতে পারেন না। গোর্কির মা একেবারে আলাদা।

ঠিক এই ভাবেই সত্যজিৎ রায়‌ও ক্রমশ দূরে সরে গেছেন গ্রামের মানুষজনদের হৃদয় থেকে। গ্রামের দৃশ্য দেখা নেই কিংবা গ্রামীণ চরিত্র মঞ্চে এলেই গ্রামটাকে চেনা যায় না। মানুষের দুর্ভেধ্য চরিত্রের মতোই গ্রাম কিংবা শহরের সাধারণ মানুষ। আমরা অঞ্জলির পরামর্শকে অভিনন্দন জানাই।

ক্রমশঃ 

One thought on “শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র | পর্ব – ১১

  1. It was an excellent piece. Thanks for the post in the journal. Would like to get links regularly

Comments are closed.