অভীক ভট্টাচার্য
সে কবেকার কথা। অথচ এখনো যখন ভাবতে চাই বা ভাবতে ভাবতে মাথায় ভেসে ওঠে তখন মনে মনে হাসি আবার বিস্মিত হই। যে বিস্ময় আনন্দ দেয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা দেয় তা হলো শিক্ষা। না, কোনো প্রথাগত শিক্ষা নয়। মুক্ত শিক্ষা, অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা, প্রাত্যহিক ঘটনাবলীর শিক্ষা। এসবই নিজের মত লিখে যাই ডায়েরীর পাতায়। অন্য কোন সময়, অন্য কোন ব্যক্তি সে সবে চোখ বোলালে হয়তো অবাক হবেন কিন্তু শিখতেও পারেন নিজের মত করে।
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ( বিশ শতকের শেষ ভাগে ) বাংলা জুড়ে ( মূলত পশ্চিমবঙ্গ ) নানা জেলার সদর সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাট্য চর্চার সাথে সাধারণ মানুষের সংযোগের অন্যতম হাতিয়ার ছিল ‘নাট্য প্রতিযোগিতা’ বা নাটকের কম্পিটিশান। আর তারই হাত ধরে ছোট থেকে বড়, নাটকের নির্দেশক থেকে সাধারণ নাট্যজন সকলের কাছে অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ‘একাঙ্ক নাটক’ কথাটা। কিন্তু সময়ের বহমান ধারায় নতুন শতকে ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতা আয়োজনের প্রবণতা কমতে শুরু করে যা আজ প্রায় নিঃশেষের পথে। কিন্তু নাট্যচর্চা তো থেমে থাকে না। ধীরে ধীরে সেই পথ পরিবর্তিত হলো উৎসবে। একটা অন্য ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ হতে শুরু হলো। সেই উৎসব মঞ্চে আমরা পৌঁছতাম রাতের পর রাত। যা আজও চলেছে বাংলা জুড়ে। এতগুলো কথা বললাম শুধুমাত্র আবহ নির্মাণের তাগিদে। এবার আসি আসল কথায়।
গোবরডাঙ্গা নক্সার একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও জনপ্রিয় নির্মাণ ‘জীয়ন পালা’। তিমির বরণ রায় রচিত এই নাট্যের নির্দেশক আশিস দাস। এই নাট্যের নির্মাণ প্রক্রিয়া, উপস্থাপনা যেমন অত্যন্ত মনোগ্রাহী, নাটকের বিষয়বস্তুও আকর্ষক। ফলে প্রতিটি রাতের প্রতিটি মঞ্চের উপস্থাপনায় এক অন্য রকমের অনুভূতি এনে দিতো দর্শক মনে। সেই সাথে আমাদের নাট্যচর্চার জন্য আরো এনার্জি সঞ্চিত হতো পরবর্তী দিনের জন্য। এমনই বেশ কয়েকটি নাট্য সন্ধ্যা অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক অনেক ব্যতিক্রমী হয়ে রয়েছে। তার কারণগুলিও মজার। এমনই একটা বা দুটো ঘটনা উল্লেখ করবো।
সেই সময় বা বেশীরভাগ সময় শীতকাল জুড়ে আমাদের নাট্য প্রদর্শনের ঢল নামে। যা আজও অনেকটাই প্রবহমান। তো, তেমনই এক সন্ধ্যায় বাংলার এক প্রান্তে একটি মাচা বাঁধা নাট্য উৎসবে গোবরডাঙ্গা নক্সা’র ‘জীয়ন পালা’ অভিনয় হবে। সময় আসতেই আমাদের পালা শুরু হল। অস্থায়ী আয়োজনে দর্শক ভরা মাঠ। নাট্যটির সময়সীমা প্রায় এক ঘন্টা। একেবারে শেষদিকে জমিদারের গাঁয়ের উঠোনে যখন নাটকের মধ্যেই পালা চলতে থাকে তখন জমিদার ও তাঁর দলবল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের প্রশ্ন তুলে পালা বন্ধ করতে উদ্দত হয় এবং দর্শকাসনে বসে থাকা জমিদারের লেঠেল বাহিনিও চিৎকার করতে থাকে পালা বন্ধ করার জন্য। পালা বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ করে এমন ঘটনায় দর্শক স্তম্ভীত হয় ও সত্যি ভেবে নেয় পালা বন্ধ করছে ক্ষমতাবানেরা। দর্শক যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকে। অনেকে মাটিতে পড়ে যান। অনেকে ভয়ে চিৎকার করতে থাকেন। সে এক উল্টো অবস্থা। অবশেষে নির্দেশক আশিস দাস সহ আমরা সকলে মঞ্চে এসে ( স্ক্রিপ্টের বাইরে ) ওই উৎসবের আয়োজকদের সাথে মাইক্রোফোনে গলা মিলিয়ে দর্শকদের বোঝাতে থাকি যে, এটা নাটকের অংশ, সত্যি ঘটনা ঘটছে না। কয়েক মিনিট সময় লাগে ঘোর ভাঙতে। তারপর আশ্বাস পায় দর্শক। নাটকের বাকি অংশ শেষ হয়। ওইদিন শো শেষে আমরা যখন সাজঘরে মেক আপ তুলতে ব্যস্ত, তখন একজন বৃদ্ধা মহিলা দর্শক এসে আমাদের নাটক ও অভিনয়ের প্রশংসা করে বলেন, এমন নাটক তিনি জীবনেও দেখেননি। তিনি ভেরেছিলেন সেখানে সতিই মস্তানরা এসে পালা বন্ধ করছেন। তাঁর হৃদকম্প শুরু হয়েছিল। আর যেন এমন পালা না করি সে মন্তব্যও তিনি করেন। অর্থাৎ জীবনের ঘটনার সাথে নাটকের সরাসরি মিল ঘটলো। সেই সংযোগের কারণেই এমনতর ঘটনা।
আমরা যারা এখন তুলনামূলকভাবে ছোট, ব্রেখট বা স্তানিস্লাভস্কি বা বোয়াল-এঁদের সামগ্রিক নাট্যচর্চা বা তত্ত্ব সম্বন্ধে খুব জ্ঞানী হয়েছি এমনটাও নয়। তবে এমনতর ঘটনা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে আসলো মগজে। সেখান থেকেই চললো নাট্যের জোড়, সমাজ সংযোগ ইত্যাদির বিশ্লেষণ। এই তো আমাদের শিক্ষা, বোধ আর জ্ঞানের পথ। হাতে কলমে কাজের, চর্চার ফলাফল। যাই হোক এ ধরনের ঘটনা আমার জীবনে পরর্তীকালে আরও অন্যান্য নাট্যদলের নাট্য প্রদর্শনে বেশ কয়েকবার ঘটেছে যা আমাকে থিয়েটার ও মনোসামাজিক সম্পর্কের খোঁজে সহায়তা করেছে ও আজও করে চলেছে। আগামী পর্বগুলিতে সুযোগ পেলে অবশ্যই বলবো।
অভীক ভট্টাচার্যর ধারাবাহিক লেখা — থিয়েটারের পথে পথে, লেখাটি পড়তে পড়তে সত্যিকার জীবন দর্শনের পথ খুঁজে পাই।