থিয়েটারেই জীবন খুঁজে পায় সিউড়ির তথাগত

বিজয়কুমার দাস 

সিউড়ির তথাগত চক্রবর্তী যে থিয়েটারের বাঁধনে বাঁধা পড়বেই, এ তো জানা কথা। কারণ ছোট থেকেই থিয়েটারের সংসারে বেড়ে ওঠা তার। বাবা বাবুন চক্রবর্তী বীরভূমের থিয়েটারে প্রথিতযশা নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা। দিদি বহ্ণি চক্রবর্তী থিয়েটারের সুপ্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। বাবুন চক্রবর্তী একজন কুশলী নাট্য পরিচালক, আবৃত্তিকারও। তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে বহু থিয়েটারকর্মী। আর সেসব দেখতে দেখতেই বেড়ে উঠতে উঠতে তথাগত ভালবেসেছে থিয়েটারকে।
জেলার আনন গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার ছিলেন বাবুন চক্রবর্তী। পরে বীরভূমের আনন এর প্রতিষ্ঠাতা। তথাগত সেই ছেলেবেলায় দেখেছে তাদের ইরিগেশন কলোনির বাড়ি থেকেই আনন এর নাটকের সেট উঠেছে গাড়িতে। মা উমা চক্রবর্তী গান গাইতে গাইতে চার বছর বয়সের তথাগতকে খাইয়ে দিয়েছে থিয়েটারের ব্যস্ততায়। তথাগত দেখেছে, তার দিদি বহ্নি হয়ে উঠেছে থিয়েটারের অভিনেত্রী। তাই তথাগতও সেই থিয়েটারের সংসারে বেড়ে উঠতে উঠতে বুঝে নিয়েছে, এটাই তার আসল ঠিকানা।

লেখাপড়া সিউড়িতেই। সিউড়ির কোরক নার্শারী, প্রণবানন্দ সরস্বতী শিশু মন্দির, বেণীমাধব ইন্সটিটিউশন, বীরভূম মহাবিদ্যালয়ে পড়াশুনো। কিন্তু মঞ্চে নামা সেই ছোটবেলাতেই। উজ্জ্বল হকের নির্দেশনায় ” অন্ধের নগরী চৌপট রাজা ” নামে হিন্দি নাটকে ছোট জাতবালা চরিত্রে।একসময় নাটকের সেটের উপকরণগুলোই ছিল তথাগতর খেলার সামগ্রী। খাটে মশারী টাঙানোর স্ট্যান্ডে দড়ি আর চাদর টাঙিয়ে যে বালক নাটক নাটক খেলা খেলত সে পরবর্তীতে থিয়েটারের অভিনেতা এবং নির্দেশক হয়ে উঠল। সিউড়ির সীমানা ছাড়িয়ে কলকাতার মিনার্ভা, চেতনা পর্যন্ত পৌঁছে গেল নাটকের টানেই। নিজেকে গড়ে তুলল থিয়েটারের জন্য। একদিকে বাবা বাবুন চক্রবর্তীর যোগ্য সহকর্মী, অন্যদিকে স্বতন্ত্রভাবে থিয়েটারের নানা কাজে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়া।

সিউড়ির আনন থেকে বীরভূমের আনন এ বেশ কিছু নাটকে অভিনয়। বীরভূমের আনন এ কাল বা পরশু ( ২০০৯), শনিবার (২০১২), মরীচিকা (২০১৫), বশীকরণ (২০১৫) নাটক নির্মাণ। সাঁইথিয়ার বীরভূম এম্ফি থিয়েটারওয়ালা দলে বাঘ ( ২০১৫), প্রভাত ফিরে এসো ( ২০১৬), সিঁড়ি ( ২০২১) তথাগতর নির্দেশনায় নির্মিত। মিনার্ভা রেপার্টারিতে ২০১২-১৩ তে ক্যাজুয়াল হিসাবে যুক্ত থাকার পর ২০১৮-২১ এ সর্বক্ষণের শিল্পী। এই সময় পাঁচটি ছোট নাটক নিয়ে তৈরি ” পাঁচকড়ির গপ্পো”(২০১৯) সহ” সরল অঙ্ক “নাটকের নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কাজ করে।
পাশাপাশি বীরভূমের আনন দলের সব কাজেই যুক্ত তথাগত। দলের তথ্য সংরক্ষণ সহ বাবুন চক্রবর্তীর থিয়েটারের কাজ নিয়ে একটা দলিলস্বরূপ পত্রিকা নিয়ে কাজ করে চলেছে কুন্তল মুখোপাধ্যায় ও রাহুল বিদ এর সহযোগিতায়। থিয়েটারের কর্মশালা নিয়ে তথাগতর অভিজ্ঞতা তার থিয়েটার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। শূদ্রক ও আনন এর আয়োজনে “শিক্ষায় মূল্যবোধ নাট্যিক প্রয়োগ” বিষয়ক কর্মশালা (২০১২) সহ মিনার্ভার কর্মশালা ভিত্তিক প্রযোজনা হাজু মিঞার কিস্যা, নাসিকাপুরাণ, মরাচাঁদ নাটকে অভিনয়। মিনার্ভাতেই দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, আশিস চট্টোপাধ্যায়, সুদীপ্ত কুণ্ডু, সুদর্শন চক্রবর্তী, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম হালদারের মত পরিচালকদের সান্নিধ্য ও প্রশিক্ষণ তথাগতর থিয়েটার শিক্ষাকে শক্তিশালী করেছে। এছাড়া বীরভূমের উজ্জ্বল হক, বাবুন চক্রবর্তী,পীযূষ দে, উত্তম চট্টোপাধ্যায়, জয়দেব সাহা, কুমার শ্রীজিৎ সরকার, নির্মল হাজরার পরিচালনাতেও নানা নাটকে অভিনয় করেছে তথাগত। ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির ” কালের যাত্রা ” প্রযোজনায় কুমার রায় আর দেবেশ রায়চৌধুরীর সাহচর্যে কাজ করার অভিজ্ঞতাও তথাগতর থিয়েটার জীবনের ঝুলিতে রয়েছে ।

শুধু থিয়েটারকে ভালবেসেই সে পৌঁছে গেছে কলকাতার চেতনা নাট্যদলে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় মানুষ এবং কোলবালিশ, মারীচ সংবাদ, মৃত্যু সংবাদ, চলচ্চিত্ত চঞ্চরী, সুজন নীল মুখোপাধ্যায় পরিচালিত হরিপদ হরিবোল নাটকে অভিনয় করেছে। অভি চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ব্রাত্য বসুর মৃত্যু ঈশ্বর যৌনতা ( অশোকনগর ব্রাত্যজন) এবং মরাচাঁদ ( ওয়েক আপ,সাঁইথিয়া) নাটকেও অভিনয় করেছে তথাগত। তার অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র : তারাদাস ( মানুষ এবং কোলবালিশ) , হাজু ( হাজু মিঞার কিস্যা), ইন্দ্রজিৎ ( এবং ইন্দ্রজিৎ) , পবন ( মরাচাঁদ), শেফালী ( বদনচাঁদ লগনচাঁদ)। এগুলোর মধ্যে আবার তারাদাস এবং ইন্দ্রজিৎ বিশেষভাবে প্রিয় চরিত্র। বীরভূমের আনন এর কাল বা পরশু, চৈতালী রাতের স্বপ্ন, এবং ইন্দ্রজিৎ, রাজরক্ত, কবয়:, জগাখিচুড়ি সহ তার অভিনীত নাটকের সংখ্যা ২৭ বছরে ৮৬ টা। এ পর্যন্ত ৬৩৩ বার বিভিন্ন নাটকে মঞ্চে নেমেছে তথাগত।

মিনার্ভা থিয়েটারের রাজা লিয়ার ( সুমন মুখোপাধ্যায়), দেবী সর্পমস্তা (দেবেশ চট্টোপাধ্যায়), চন্দ্রগুপ্ত ( কৌশিক চট্টোপাধ্যায়), আশিস চট্টোপাধ্যায় ( হাজু মিঞার কিস্যা), বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ( নাসিকাপুরাণ) সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তাকে অভিনেতা হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আর বাবা বাবুন চক্রবর্তীর কাছে তো অনবরত শিখেছে থিয়েটারের অ আ ক খ।পুরোসময়ের থিয়েটারকর্মী হয়ে বাঁচার স্বপ্ন লালন করে চলেছে অবিরত । কিন্তু করোনাজাত বিপর্যয় তাকে ভাবাতে শুরু করেছে। কখনো কখনো মনে হয়েছে, টেকনিক্যাল কাজে আরো পারদর্শীতা থাকলে সুবিধা পাওয়া যেতো হয়তো! শুধু অভিনয় নিয়ে বেঁচে থাকা ঝুঁকির বিষয়। তবু ইচ্ছা থেকে সরে দাঁড়ায়নি, থিয়েটারকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে অভিনেতা নির্দেশক তথাগত চক্রবর্তী।

14 thoughts on “থিয়েটারেই জীবন খুঁজে পায় সিউড়ির তথাগত

  1. বাঃ খুব ভালো লাগলো। ব্যক্তিগত ভাবেও চিনি খুব ভালো মানুষও বটে।

  2. তথার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা দারুণ। ভাল থাকিস।

    1. গনগনে গরমে আমাদের চনবনে কাজ ছিল মরাচাঁদ।

      1. লড়াই চালিয়ে যা, আমরা জানি তোর জিত নিশ্চিত। পাশে আছি সারাজীবন। 🥰🥰🥰🥰

    2. চন্দন দা’র রক্তে থিয়েটার। সেই ছোটবেলার কলোনির মাঠ হয়ে আজকের মিনার্ভা মঞ্চ – সবেতেই সমান বিচরণ। শহর সিউড়ি থেকে নগর কলকাতা, যেখানেই দেখা হয়, শুরু হয় আমাদের মিঠে-নাটুয়া-আড্ডা। ভালো থেকো, একদিন তুমি চুড়োয় পৌঁছাবে… ❣️

    1. লড়াই জারি থাকুক l তথাগতর সাথে কাজের অভিজ্ঞতা দারুণ l
      তথাগতর সাথে Birbhum Amphitheatrewala-র যাত্রা দীর্ঘজীবি হোক l ❤❤❤

  3. ধন্যবাদ অসীম দা

  4. তথাগত চক্রবর্তী কে অভিনন্দন । আরো সাফল্য কামনা করি ।

  5. মঞ্চে নেমেছেন ? অভিনেতা মঞ্চে ওঠেন নাটক শেষে মঞ্চ থেকে নামেন । তাই তথাগত বাবু ৬৩৩ বার মঞ্চে উঠেছেন । এটা লেখা হলে পড়তে আরও ভালো লাগতো । বাকি এই রকম তথ্য সমৃদ্ধ লেখাকে কুর্ণিশ ।

  6. বন্ধু তুমি এগিয়ে যাও ।আরও অনেক বড় নাট্যকার হও।

Comments are closed.