কমল সাহা
ছেঁড়াতার / শেষ পর্ব
নূতন ধরনের নূতন নাটকের এই চরম দুর্ভিক্ষের দিনে বহুরূপী সম্প্রদায়ের পরিচালক জনসাধারণের সামনে একসাথে তিন তিনখানি অভিনব নাটক নিয়ে এসে আমাদের বিস্মিত করেছেন। সাধারণ রঙ্গালয় যা করতে পারছে না, আওতার বাইরে থেকেও তাঁরা যে তা করতে পেরেছেন, এ জন্যে তাঁদের মুক্ত কন্ঠে ধন্যবাদ দিতে পারি। নূতনত্বের জন্য চাই যে নূতন দল, পৃথিবীর দেশে দেশে বারংবার সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। ছেঁড়াতার নাটকখানিকে নিখুঁত বলে গ্রহণ করা যায় না। সংলাপের প্রাদেশিকতা তার সার্বজনীনতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। অনাবশ্যক বাহুল্যের জন্য তার নাটকীয় ক্রিয়ার গতিকেও মন্থর করে এনেছে। যদিও কাঁচির যথা ব্যবহারে এ ক্রুটি অনায়াসে সংশোধিত হতে পারে। নাট্যকার অন্নবস্ত্রের সমস্যার সঙ্গে পারিবারিক জীবন সমস্যার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেননি। সাধুকেও দেখিয়েছেন অসাধুকেও দেখিয়েছেন। চিরাচরিত থিয়েটারি প্রথাকে মর্যাদা দেবার জন্য পূর্ণের জয় ও পাপের পরাজয় দেখাবার চেষ্টা (করেন নি)।
… রঙ্গালয়ে একটানা পুরাতন নাটকের উৎপাৎ বন্ধ করতে পারেন একজন নূতন ও তরুণ অভিনেতা। … যাঁদের দৃষ্টি আবদ্ধ থাকবে প্রধাণত বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে। (মহর্ষি, নাট্যকার, নির্দেশক ও তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ের প্রশংসা) …
সম্প্রদায় দৃশ্যপটকে প্রাধান্য না দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছেন। চিত্রকরের সাহায্য না নিয়েও অভিনয় যে শ্রেষ্ঠ হতে পারে, এইটে দেখাতে পারাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।
— হেমেন্দ্রকুমার যায়/বসুমতী/৩০.১২.৫০
প্রয়োগ বিজ্ঞানে বহুরূপী নূতনত্ব এনেছেন, মাঝে আমার শত্রুপক্ষ হয়তো বলবে গীতিনাট্য ধরণ, কিন্তু সত্যই দর্শক সাধারণ বলবে এ প্রয়োগ অভিনব নব্য অভিনয় রীতির সঙ্গে দেশজ ভাবে তথা মাত্রা ইত্যাদির একটি অভিনব সমন্বয় হয়েছে, দুটি রীতি অদ্ভুত ভাবে মিশ্রিত হয়েছে বলা যেতে পারে। এর আগে বহু নাটকে কিছু কিছু চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তা আমরা পড়েছি, দেখিনি। বহুরূপীর প্রচেষ্টা সার্থক।
— কমল কুমার মজুমদার/সচিত্র ভারত ২৩.১২.১৯৫০
নীলদর্পণ || লালদর্পণ
২৭.৮.১৯৫০ দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ অভিনয়। প্রযোজনা : নাট্যচক্র। নির্দেশক : বিজন ভট্টাচার্য। সম্পাদনা : দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়। রেলওয়ে ম্যানশন ইনস্টিটিউট্যুট। (পরে কালিকায়)
তোরাপ :বিজন ভট্টাচার্য, ক্ষেলমণি :গীতা সেন। আদুরি :আরতি মৈত্র, কৃষক : ঋত্বিক ঘটক, সাবিত্রী : শোভা সেন, কৃষক : সজন রায় চৌধুরী, সৈরিদ্রী : সীতা মুখোপাধ্যায়
‘ জ্ঞান মজুমদার – আমাদের জ্ঞান-দা — যদিও তবলিয়া ছিলেন, উনি কর্মী হিসেবে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। জ্ঞানদা, বিজনদা, দিগিনবাবু, ঋত্বিক, সুধীপ্রধান, মমতাজ আহমদ খান, আমি, আমরা সকলে মিলে নাট্যচক্র নামে নতুন দল গড়ে নীলদর্পণ নাটক প্রযোজনার উদ্যোগ নিলাম। এর আগে গণনাট্য সংঘ বহু তোড়জোড় করেও এ নাটক মঞ্চস্থ করে উঠতে পারেনি। শুনেছিলাম শম্ভুবাবু এসে নতুন ভাবে এ নাটক পরিচালনা করবেন। কিন্তু তা হল না’…
— শোভা সেন ।। স্মরণে-বিস্মরণে
আমরা আগেই বলেছি, গণনাট্য নীলদর্পণ করতে পারেনি শম্ভু মিত্রের আপত্তির জন্য। দিগিনবাবুর সম্পাদনা তাঁর পছন্দ হয়নি। এই নিয়ে তীব্র মন কষাকষি। এখন এ নাটক নির্দেশনার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি নীলদর্পণকে ইস্যু করে গণনাট্য ছেড়ে বহুরূপী নিয়ে নিমগ্ন । এইসব লালদর্পণে তাঁর রুচি নেই। তিনি ভেবেছিলেন, ছোট বৌয়ের অত্যাচার দেখিয়ে এটাকে নীলাভ দর্পণ করে তুলবেন নবান্নের আঙ্গিকে!
১০.৮.১৯৪৯ শ্রীরঙ্গমে শিশিরকুমার অভিনীত নির্দেশিত এবং জিতেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় রচিত ‘পরিচয়’-এর প্রথম অভিনয়। শশাঙ্ক চাটুয্যে চরিত্র চিত্রন নিয়ে দিগিনবাবু ‘পরিচয় নাটকে শিশিরকুমার’ নামে একটি সুদীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন বিচিত্রা পত্রিকায় ১৩৬৬ সালে। তার এক জায়গায় দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন : ‘অপেশাদার মহলের বহু অভিনেতা শিশিরকুমারের (এই) বৈশিষ্ট্যগুলিকে অনুকরণ করতে গিয়ে অনেক সময় হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করতেন। … বড় প্রতিভাকে অনুশীলন করা যায়, অনুকরণ করা যায় না।’ এই সময়টাতেই নীলদর্পণ নিয়ে শম্ভু মিত্রের তীব্র মতবিরোধ চলছিল দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ‘অপেশাদার মহলের বহু অভিনেতার’ অন্যতম কি শম্ভু মিত্র তাহলে? তিনি বহু চরিত্র চিত্রণে শিশিরবাবুকে অনুধাবণ করে ছিলেন।
বহুরূপীর বিজ্ঞপ্তি
অগাস্ট ১৯৫০ ∆ বিজ্ঞপ্তি /বহুরূপী
এই নাট্যাভিনয় সম্পর্কে আপনার যা কিছু নিন্দা বা প্রশংসা মনে আসে বা যে সমালোচনা আপনি করতে উৎসুক, সে সমস্ত যদি নিম্নলিখিত ঠিকানায় আমাদের কাছে লিখে পাঠান তাহলে আমাদের সংঘ আপনার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকবে।
— অশোক মজুমদার, সম্পাদক
সম্ভাব্য প্রযোজনার বিজ্ঞপ্তি / বহুরূপী
১. উলুখাগড়া / শ্রী সঞ্জীব
২. কাবুলিওয়ালা / রবীন্দ্রনাথ / নাট্যরূপ : কানাই বসু
৩. ছেঁড়াতার / তুলসী লাহিড়ী
‘আমাদের মনে হয়েছিল যে ইংরেজ শাসনের ফলে আমাদের দেশে গ্রাম ও শহরের মধ্যে একটা অবাঞ্ছিত দূরত্ব এসে গিয়েছে। এবং এই ছায়ার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ আমরা খানিকটা করতে পারি যদি আমরা শহর সম্পর্কীয় নাটকের পর গ্রাম সম্পর্কীয় নাটক করি। তাই পথিক অভিনয়ের পরে আমরা প্রথমে করি উলুখাগড়া, তার পরে করি ছেঁড়াতার। এবং ছেঁড়াতারের পরেই করি চার অধ্যায়।’
— শম্ভু মিত্র / ফিরে তাকাই / এপ্রিল ১৯৭৩ / বহুরূপী: ৪০
(গ্রাম শহরের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গ আরো স্পষ্ট হবে কাটোয়ার ‘ অঞ্জলি ‘ পত্রিকার সমালোচনায়)
ক্রমশঃ
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা।