একাধারে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী ও ১৮টি সিনেমা হাউসের মালিক জে. এফ. ম্যাডান তখন উত্তর কলকাতার কর্ণওয়ালিশ (বর্তমান শ্রী সিনেমা) থিয়েটারে বেঙ্গল থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানী নামে এক নতুন বাংলা থিয়েটার খুলেছেন। স্টার, মিনার্ভা আর মনোমোহন তখন প্রতিদ্বন্দ্বী হল। প্রতিযোগিতায় কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না মি: ম্যাডানের জামাই রুস্তমজী ধোতিওয়ালা। লোক মুখে শুনছেন অধ্যাপক শিশিরকুমারের অভিনয় খ্যাতির কথা। সঙ্গে সঙ্গে শিশিরকুমারকে অনুরোধ জানান বেঙ্গল থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানী পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য। সময় চাইলেন শিশিরকুমার। চিন্তা করতে লাগলেন অধ্যাপনা পেশা ত্যাগ করে পুরোপুরি থিয়েটারকে বৃত্তি করা উচিৎ হবে কিনা। পরামর্শ করলেন মা কমলেকামিনী দেবীর সঙ্গে। বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করে মাসে পাচ্ছেন দুশো টাকা। আর রুস্তমজীর অফার মাসিক পাঁচশ টাকা। মায়ের সম্মতি নিয়ে ম্যাডান কোম্পানীতে যোগ দেন ১৯২০-র ডিসেম্বর মাসে। সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রথম পদার্পণ ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘আলমগীর’ নাটকে। ১০ ডিসেম্বর ১৯২১ তে নামভূমিকায় শিশিরকুমার। উদিপুরী কুসুমকুমারী। ” নাট্যাকাশে নবদিগন্ত উন্মোচন করে আবির্ভূত হলেন নট-নাট্যশিক্ষক প্রযোজক শিশিরকুমার ভাদুড়ী।”
বাংলার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ যিনি দর্শকবৃন্দের কাছে সহৃদয় হৃদয়বেদ্য নাট্যরস পরিবেশন করেছেন, বাংলা রঙ্গমঞ্চের সার্বিক উন্নতি, নট-নটীদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের জন্য “প্রাণাতিপাত করে গেছেন”। দিয়েছেন বাংলার রঙ্গমঞ্চকে “দেশজরূপ”। সেই প্রতিভাশালী উনিশ শতকের বাংলার শেষতম নাট্যব্যক্তিত্ব নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর জন্ম ২ অক্টোবর ১৮৮৯,
জন্মস্থান মেদিনীপুর শহরের ছোটবাজার অঞ্চলে, মামারবাড়িতে। পিতা হরিদাস ভাদুড়ী তখন পি. ডব্লু. ডি-র ইঞ্জিনিয়ার। পৈতৃক নিবাস হাওড়া রামরাজাতলা (সাঁতরাগাছি) চৌধুরীপাড়ায়। ছয় ভাই, এক বোন। সবার বড় শিশিরকুমার, ফলে মায়ের ইচ্ছায় ১৯১০ সালে আগ্রা প্রবাসী রায়বাহাদুর ডাক্তার নবীনচন্দ্র চক্রবর্তীর কন্যা উষাদেবীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯১৩ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে এম. এ. পাশ এবং ১৯১৪ তে বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপকরূপে যোগদান। ” লেখা পড়ায় মার্কামারা, পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলে না হলেও… কলেজ জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল-মতি, সবচেয়ে সুবুদ্ধি আর চেহারায়ও তেমনি সুদর্শণ ছাত্র ছিলেন তিনি। একটা সহজ আকর্ষণীয় শক্তি একটা মার্জিত উচ্চশিক্ষিত মন আর আচার ব্যবহারে আভিজাত্য সঙ্গে ভদ্রতা ভব্যতা, শালীনতাবোধ, রসবোধ আর সকলের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মেশবার আগ্রহ — এই সব ছিল আকর্ষণী শক্তির মূলে। মানুষ হিসেবে শিশিরকুমার ছিলেন সরল, সহজ, সোজা,ঋজু — ঋতম্ভর”।
ছাত্রজীবনে (স্কটিশচার্চ কলেজ) বহু ইংরেজি নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের অভিভূত করেছিলেন। এবং আশিটির বেশি বাংলা নাটকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে আজীবন অভিনয় করেন।
১৯১২ তে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সান্ধ্যসন্মেলন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্বর্ধনা জানানো হয় এবং পরদিন ইউনিভার্সিটির জুনিয়র মেম্বাররা রবীন্দ্রনাথের সন্মুখে কবির লেখা নাটক ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় করে। কেদারের ভূমিকায় শিশিরকুমার। কবি এই অভিনয় দেখে ২৩ মাঘ ১৩১৮ বঙ্গাব্দে শ্রী অমল হোমকে এক চিঠিতে জানিয়েছেন – তোমার ইনস্টিটিউটের বন্ধুদের জানিও তাঁদের অভিনয় আমার খুব ভাল লেগেছে। “বৈকুণ্ঠের খাতা’র এমন সুনিপুণ অভিনয় এক আমাদের বাড়িতে গগন অবনদের ছাড়া আর কারুরই পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। একদা ঐ পাটে আমার যশ ছিল।
” নাটককে কেন্দ্র করে বিয়ের পর প্রায় দিনই অর্দ্ধেক রাত্রে বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি ফিরতেন শিশিরকুমার। কখনও কখনও বন্ধুবর পান্নালাল মুখার্জীর সঙ্গে বাড়ির কাছে এসেও অনাবশ্যক আড্ডাবাজী করে সময় নষ্ট করত” … রাত বারোটা-একটা অবধি শিশিরের স্ত্রী দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন পতিদেবতার জন্যে। দাম্পত্য কলহে অল্পারম্ভে এক অভাবনীয় ট্রাজেডি ঘটে গেল সেদিন শিশিরকুমারের জীবনে। মাত্র ছ’বছর বিবাহিত জীবনে ২.৫.১৯১৬ তে শিশির পত্নী উষাদেবী গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুপূর্বে কালেকটারের কাছে স্ত্রীর বিবৃতি – “স্বামী নির্দোষ “।
এতদিনে নির্বাক চলচ্চিত্র ‘মোহিনী না একাদশীর তত্ত্ব’ (১৯২১) রাজা রুক্সাঙ্গদেব চরিত্রে অভিনয় করা হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সম্পর্ক ছেদ করেছেন ম্যাডান্ থেকে। নাট্যদল (শিশির সম্প্রদায়) প্রতিষ্ঠা করে ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৩-এ ইডেন গার্ডেন একজিবিশনে চার রাত্রি দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’ নাটকের প্রথম অভিনয় করেন। ” ডি. এল. রায়ের ধারনা এই ছন্দাবদ্ধ নাটক সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনয় হওয়া সম্ভব নয়।” শিশিরকুমার সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললেন। সে সময় প্রতিদ্বন্দ্বী আর্ট থিয়েটার সীতার অভিনয়সত্ত্ব দখল করে বানচাল করে দেন। এবার যোগেশচন্দ্র চৌধুরীকে দিয়ে নিজের মত করে লেখালেন ‘সীতা’। রাম চরিত্রে শিশিরকুমার, সীতা – প্রভাদেবী। ৬ অগাস্ট ১৯২৪ প্রথম অভিনয়ের সন্ধ্যায় দর্শক আসনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন।
প্রথম পর্বের অভিনয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব – আলমগীর, জীবানন্দ, নাদিরশাহ ও রাম। শিশিরকুমারের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জীবানন্দের পুরোমাত্রায় মিলে গেলেও সেটা আরো বেশি করে স্বভাব-সম্মত হয়ে উঠেছিল। রাম চরিত্রে জটিলতা কম, আবেগপ্রধান …, “শিশিরকুমারের পূর্ণবিকাশ … তাঁর আবৃত্তির ধরণ কখনো দ্রুত কখনো বিলম্বিত লয়ে গানের ধর্মে স্বরের উত্থান-পতন তাঁর চলাফেরা, নির্বাক অভিব্যক্তি দর্শকদের সম্মোহিত করে রাখত।” মঞ্চের ভেতরে বাইরে সর্বত্র নতুনত্বের ছাপ। সবার উপর এক দেবকান্তি অতুলনীয় কণ্ঠসম্পদের অধিকারী যাদুকর নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী যেন সারাক্ষণ মঞ্চের ওপর তাঁর মায়াজাল বিস্তার করে রেখেছে ” কোথায় নাটক, কি নাটক শুধু শিশিরকুমার আর শিশিবকুমার।
নাট্যমন্দিরে শিশিরকুমারের দ্বিতীয়বার অভিনয় দেখতে আসেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৬ সাল সেপ্টেম্বর মাস। কবির ‘গোড়ায় গলদ ‘ এর সংশোধিত নাট্যরূপ ‘শেষরক্ষা’। শিশিরকুমার সাজেন চন্দ্রবাবু। সেদিন — “রবীন্দ্রনাথ বসেছিলেন বড় আকারের লম্বা একটি সোফায়।” শিশিরকুমার যত নাটক বেছেছিলেন এবং মঞ্চস্থ করেছিলেন তার অধিকাংশই কবিকে আকর্ষণ করেনি। কিন্তু শিশিরকুমারের নির্দেশনা এবং অভিনয়ের একান্ত অনুরাগী ছিলেন কবি। ” সে কারণেই কবি নিজের নাটক মঞ্চস্থ করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন সানন্দে “। নাট্যমন্দিরে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রও আসতেন নিয়মিত। আমেরিকা যাত্রার (৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩০) পূর্বে নাট্যমন্দিরে শেষ উল্লেখযোগ্য ” ব্যর্থ সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের তপতী “, বিক্রমদেব চরিত্রে শিশিরকুমার। এই সময় থেকেই তাঁর অভিনয় প্রতিভা যেন ‘মেঘাবৃত’ হল। প্রায়ই গিরিশবাবুর সেই গল্পটা বলতেন শিশিরকুমার ‘– মদ খেলে মাতাল, না খেলে গিরিশ ঘোষ। মদ না খেলে তু ব্যাটারা কে”! তিনি মাঝে মাঝেই তাঁর চেষ্টার অকৃতকার্য হতেন। কারণ অত্যাধিক মদ্যাসক্তি। ” জীবনে তিনি আর যাই শিখে থাকুন না কেন, সংযম তিনি শেখেননি, মদের প্রতি তাঁর অসম্ভব স্পৃহা … কলেজ, জীবন থেকেই ছিল “।
১৯৩৬-এ ‘সীতা’র চলচ্চিত্রায়ণ, পরিচালনা ও রাম ভূমিকা গ্রহণ এবং ১৯৩৯-এ ‘চাণক্য’র পরিচালনা ও নামভূমিকায় অভিনয় করেন।
তাঁরই আমলে প্রথম ঐকতান বাদন উঠে গেল, আঁকাজোঁকা জমকালো ড্রপসিনের পরিবর্তে এলো ডবল কার্টেন। রোলার সিন উঠে বক্স সিনের প্রবর্তন হল, ফুট লাইট হল অবলুপ্ত, টিকিট ছাপা হল বাংলায়, রো-র পরিবর্তে পংক্তি সিট নাম্বার বা শব্দ পালটে আসন সংখ্যা লেখা শুরু। বিগত ৫০ বছর ধরে সাধারণ রঙ্গালয় যেভাবে চলে আসছিল তার আমূল পরিবর্তন হল।
নাট্যনিকেতন মঞ্চে ‘জীবনরঙ্গ’ দিয়ে শ্রীরঙ্গম শুরু ২৮ নভেম্বর ১৯৪১,
১৯৪৪ সালে গণনাট্য সংঘকে শ্রীরঙ্গম দিয়েছিলেন নবান্ন’ অভিনয়ের জন্য। ৭দিন
চলার পর শিশিরকুমার বললেন– ” আমি আপনাদের আর মঞ্চ দেব না “। আপত্তির
কারণ— ” আপনারা বৃটিশ সরকারের লোক তাই “। কে বা কারা যেন তাঁকে ভুল বুঝিয়ে ছিলেন, গণনাট্য সংঘ নাকি বৃটিশ সরকারের অর্থ নিয়ে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করছেন! শেষপর্যন্ত দেননি মঞ্চ।
গান্ধীবাদকে কখনই আমল দেননি শিশিরকুমার। তিনি বলতেন— ” শুধু অহিংসায় নয়, আঘাতের পরিবর্তে ভারত আঘাত দিতে পারবে—এই জানার পর ইংরাজ ভারত ছেড়েছে “। তাঁর বিশ্বাস এই ভুয়ো স্বাধীনতায় বাংলার সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে মানচিত্রে দাগ বুলিয়ে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করেছে। প্রতি স্বাধীনতার দিন মঞ্চে তিনি কিছু বলতেন দর্শকদের উদ্দেশ্যে – ১৫ অগাস্ট ১৯৫৩ শ্রীরঙ্গম থেকে বললেন— ” আমি এই বলে আপনাদের সতর্ক করতে চাই যে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জ (UN) কোরিয়ার মত কাশ্মীরেও নাক গলাবে “। যদিও তিনি ‘কমিউনিস্ট’ ছিলেন না। তবে বামপন্থী ধারনার কাছে এসেছিলেন। শিশিরকুমার নিয়মিত ফুটবল খেলার মাঠে যেতেন, তাঁর প্রিয় দল মোহনবাগান।
১৯৫৯ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন।
নাট্যনিকেতন মঞ্চে শ্রীরঙ্গম প্রতিষ্ঠার কাল থেকে এবং শ্রীরঙ্গম মঞ্চ ছাড়ার আগে পর্যন্ত তাঁকে অবিরাম সংগ্রাম করতে হয়েছে। বলা যেতে পারে তাঁর সমগ্র নাট্যজীবনই সংগ্রামী জীবন। মঞ্চের মায়ায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আবদ্ধ ছিলেন। তাই মঞ্চহারা হয়েও, তিনি অভিনয় ত্যাগ করেননি। সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের অভিনয় জীবনের শেষ অভিনয় (১০ মে ১৯৫১) মহাজাতি সদনে ‘রীতিমত নাটক’ এবং ৩০ জুন জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন শ্রীরঙ্গমের বড়বাবু শিশিরকুমার। মৃত্যুপূর্বে বলে যাবেন— ” আমার মৃতদেহ যেন গুরু গিরিশচন্দ্রের পাশে রাখা হয়। যেন শবদেহ কোন রঙ্গালয়ে না নেয়া হয়! মালা টালার প্রয়োজন নেই “…
ঋণ: নাট্যচিন্তা, নাট্য অভিধান, বাংলা নাট্যকোষ
দুর্দান্ত লেখা। শিশিক্ষুদের জন্য প্রয়োজনীয়।
ভীষণ ভালো লেখা ❣️