আমাদের চারপাশে কত ঘটনাই ঘটে যায়। সব ঘটনার কারণ আমরা খুঁজি না। কত ঘটনাতো অজানাই থেকে যায়। লোকজ আঙ্গিকেরও যেন এমন ধারাটি। কত রতন লুকিয়ে আছে কত অচিন গাঁয়ে। পূর্ব বা পশ্চিম বাংলায় কত কবি আছেন? উত্তর,অগুনতি। তাঁদের হরেক বই ছাপা হয়, কারও পুরস্কারপ্রাপ্তি ঘটে। বাংলার যে লোকজ কাব্যসংস্কৃতি তা-ও অসংখ্য স্বভাব কবিয়াল, এন্টনি কবিয়াল, ভোলা ময়রার আসর জমানো চাপান-উতোর সময়ের সাক্ষী।
ইতিহাস বলে, বাংলা সাহিত্যের মধ্যেও মধ্যযুগ ও আধুনিকযুগের সন্ধিক্ষণে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কবিগান সৃষ্টি হয়েছে। কল্পনা আর বাস্তবের শব্দরূপকল্পে স্বতঃস্ফূর্ত ও তাৎক্ষণিক ভাষা প্রয়োগ করে কবিয়ালরা গ্রামের প্রান্তিক দুঃখী মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন। কখনো বা মনে জুগিয়েছেন বল। দিন গড়িয়েছে, আসর মাত করা কবিরা হারিয়ে গেছেন এই বাংলার ধুলোমাটিতে। কারণ, এই কবিগান যে মুদ্রিত নয়। রসিক কবিয়াল অসীম সরকার বলেন – যারা কবিয়াল, তারাই ‘সরকার’, ‘সুরকার’ থেকে ‘সরকার’। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, বাজখাই গলা, অব্যর্থ সুর, স্পষ্ট উচ্চারণ ও মানুষকে মোহগ্রস্ত করার অদ্ভুত রহস্য – এসবই ভালো কবিয়াল এর লক্ষণ। ঠিক এমনটাই যেন মিলে গেল বীরভূমের লাভপুরের কবিয়াল সুভাষ দাসের কথার সঙ্গে। ধ্রুব মন্ডল তার দীক্ষাগুরু।
কবিয়ালদের যেমন রামায়ণ, মহাভারত, ব্রহ্মপুরাণ,শূন্যপুরাণ, চৈতন্যচরিতামৃত বেদ পড়তে হয় তেমনই জানতে হয় সবসময়ের সমাজের গরন ও তার চলন সম্পর্কে।
আসর জমানো পদ খুঁজে পেতে চরিত্রের অবস্থান বলে দেন তাঁরা। কখনো টপ্পার ঢঙে কখনো পাঁচালী সুরে তাঁদের উপস্থাপনা চলে। আদিরসাত্মক কবিগানের পরিশীলন ঘটিয়ে যে কবিরা বাংলায় পথিকৃত হয়ে আছেন, তাঁরা কবিয়াল রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার, কবিয়াল গুনকার হরিচরণ আশ্চর্য, কবিরাজ রাজেন্দ্রনাথ সরকার, পাগল বিজয় সরকার । কবিয়াল অসীম সরকারের মাথায় ভবা পাগলার আশীর্বাদ রয়েছে।
মুখকে অস্ত্র করে একে একে পঁয়ত্রিশটি বছর কেটে গেল তাঁর এই কাব্যময়তার সংসারে। তাঁর কাব্যগুরু রসিক সরকার। কিন্তু এই সময়ে এসে একজন সদ্ গুরুর সৎশিষ্য হিসেবে তিনি জানালেন, এখন যাঁরা কবিগান করেন, তাঁদেরই আগে এই গান শেখানোর প্রয়োজন। অপরের পদ মুখস্থ করে তাৎক্ষণিক নাম কেনা ঠিক নয়। এভাবে বড় শিল্পী হওয়া যায় না। এ বড় সাধনার ব্যাপার।
আগামী প্রজন্মকে কাব্যমুখী করতে তিনি একটি অ্যাকাডেমি গড়ছেন। এটাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরম প্রাপ্তি। বীরভূম, মালদা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ জুড়ে এই লোক – কবিয়ালদের অধিক্য। শিব শংকর পাল, কিশোর কোনাই, লম্বোদর – গুমানি জুটি, প্রসন্ন পাল, হেমন্ত বোস – লিখতে গেলে নামের তালিকা বেড়েই চলবে। পয়ার মিশ্রিত ছন্দে বীরভূমের কবিয়াল সুভাষ গান বাঁধলেন। তার মাথায় যে মোহরদি, শান্তিদেব ঘোষের হাত। টোলে সংস্কৃত পড়েছেন তিনি। সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণে তার প্রমাণ মিলল। গানই ‘জ্ঞান ‘ – এই বিশ্বাস মনে নিয়ে তিনি সেই জ্ঞানকে কবিগানের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার দায় অনুভব করেন। ‘কবি বাউল কীর্তন বাংলা নিজস্ব ধন ‘- কবিয়াল সুভাষের এই কথার রেশ ধরেই শেষ করি ছন্দের অসীম সু-ভাষ এর মাধ্যমে –
অষ্ট অঙ্গের রুপাবতার, বন্দনা করি প্রথম সবার
মায়ের কাছে করি আবদার, অনুযোগের সুরে।।
সখা – সখীর প্রশ্ন নিয়ে ধুয়াধারী হও তৈয়ার
জীবন – মরণ সাধন- ভজন সুরে পড়ুক ঝরে।।
লেখাটি ভাল লাগল না, অসীম সরকার আর সুভাষ দাসের সঙ্গে কথা বলেই একটা লেখা লিখে দিলেই তো হল না। তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথাই নেই। হরু ঠাকুর গোঁজলা গুঁই দের নাম তো নেই-ই, নেই চাঁদ মহম্মদ গফুর, শিব শঙ্কর পাল, দিলীপ চ্যাটার্জিদের নাম ও অবদানের কথা। কবিগানের ছন্দ ও তাল বিষয়েও কিছু নেই। খুব হতাশ হলাম।