নাট্যশাস্ত্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ
ভরতের নাট্যশাস্ত্র বলে যা কথিত তাতে নাট্য উৎপত্তির কারণ হিসেবে একটি আখ্যান আছে। সেই আখ্যানটির মধ্যে দিয়ে আমরা এর উৎপত্তি এবং বিস্তারের পদ্ধতি খানিকটা অনুমান করে নেব। অনুমান শব্দটির প্রয়োগ এই কারণে করা যে ঐতিহাসিক সত্য জানার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত ইত্যাদি লাগে তা এখন আর উপস্থিত নেই। কিন্তু কাহিনী এবং তার কাঠামোকে বিশ্লেষণ করলে আমরা কিছু ধারণা তৈরী করতে পারি যা প্রাথমিকভাবে নাট্যশাস্ত্রের উৎপত্তিকে বুঝতে সাহায্য করবে। তারও আগে আমরা নাট্যশাস্ত্রের নাট্যোৎপত্তি অধ্যায়কে একটু বুঝে নিই, পৌরাণিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে।
বৈদিক যুগের দেব-দেবীরা ক্রমাগত প্রাধান্য হারিয়েছে পৌরাণিক যুগ আসতে আসতে, এ কথা আমাদের জানা। পৌরাণিক যুগে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই ত্রিদেবের প্রভাবের কথা বলা হলেও, মুখ্যত শৈব এবং বৈষ্ণবদের মধ্যেই প্রাধান্যের দ্বন্দ্ব চলেছে। ব্রহ্মা অনুসারীরা বহুকাল আগেই এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়েছে। অথবা কেউ কেউ বলে থাকেন, পিতামহ ব্রহ্মা থেকে প্রজাপতি হয়ে ব্রহ্মা অবশেষে অবাঙমানসগোচর ব্রহ্মে পরিণত হয়েছিলেন। সেই বিমূর্ত ব্রহ্মের ধারণাও জনজীবনে খুব একটা প্রাধান্য লাভ করেনি।
আমরা জানি শৈব অংশটি তথাকথিত ইন্দো-ইউরোপিয়ান ইন্দো-ইরানিয়ান দেবতাকূলের মধ্যে পড়ে না। আবার বিষ্ণুর কথা নাট্যশাস্ত্রে থাকলেও, নাট্যোৎপত্তিতে অবদানের প্রসঙ্গে তেমন বিশেষভাবে নেই। শিবের অবদানও কিন্তু সচরাচর আমরা যা ভাবি ততটা নয়। শিবকে কাহিনীতে জোড়া হলেও তাণ্ডব শেখাচ্ছে তণ্ডু মুনি। লাস্য শিক্ষিকা দেবী পার্বতী। কৈশিকী বৃত্তির প্রসঙ্গে শিবের কথা এলেও নাট্যোৎপত্তির কার্যকারণ যদি আমরা দেখি, দেখব দুজন দেবতাই মুখ্য। প্রথমজন ব্রহ্মা। দ্বিতীয়জন ইন্দ্র।
ইন্দ্র বাকী দেবতাদের নিয়ে ব্রহ্মার কাছে পৌঁছোচ্ছেন। দেবতাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে সত্যযুগ অতিক্রান্ত হওয়ার সময় এবং বৈবস্বত মন্বন্তরে ত্রেতাযুগ শুরুতে এঁরা ব্রহ্মার কাছে শূদ্রদের উপযোগী বেদ নির্মাণের আবেদন নিয়ে গেলেন, যা একাধারে দৃশ্য এবং শ্রাব্য হবে। কারণ শূদ্ররা বেদপাঠের অধিকারী নয়। আর জনসমাজ ভোগাদিতে আসক্ত এবং নানা রিপুর বশবর্তী হয়েছে। ব্রহ্মা তখন ভাবলেন তিনি ইতিহাস নিয়ে পঞ্চম বেদ সৃষ্টি করবেন। সর্বশাস্ত্রের অর্থযুক্ত, ধর্ম-অর্থ-যশলাভের উপায় হবে যা, সদুপদেশ যুক্ত হবে, ভবিষ্যৎ-এর পথপ্রদর্শক হবে এবং সকল শিল্পের প্রদর্শক হবে সেই বেদ। ঋক্ থেকে পাঠ, সাম থেকে গান, যজুঃ থেকে অভিনয় এবং অথর্ব থেকে রসসমূহ নিয়েছিলেন। তিনিই সৃষ্টি করলেন নাট্যবেদ। অর্থাৎ ইন্দ্রের অনুরোধে ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট এই বেদ।
বিয়ারস্কিদের মতন বিশেষজ্ঞরা এই অংশ থেকে সেই সময় এই দুই দেবতার প্রাধান্য নির্দেশ করেন। এই সময়কালটি কোন সময়? বেদ, ব্রাহ্মণ সাহিত্য, মহাকাব্য এবং পুরাণ – এই চারধারায় এক বৃহৎকালের সৃষ্টিকে ধারণ করা আছে। বেদ-এর প্রধান দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র পড়েন। কিন্তু এখানে ব্রহ্মা বরং প্রধান। বেদ-এর সূর্য-বরুণাদি দেবতা এখানে কোনো প্রাধান্যই পায়নি। অর্থাৎ ঋগ্বেদের কাল-এ এই যে নাট্যশাস্ত্রের চেহারা আমরা দেখছি, তা তৈরী হয়নি। আবার একেবারে পৌরাণিক সময় তৈরী হলে, বিয়ারস্কিদের মতে বৈষ্ণব প্রভাব এবং বিষ্ণুর ভূমিকা অনেক বেশীই থাকত। তা নেই। বরং অভিনবগুপ্ত যখন টীকা লিখছেন, তখন এই না থাকাকে লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু অভিনবগুপ্ত এ বিষয় মন্তব্য করেননি। দেবতার অনুপস্থিতি বিষয় মন্তব্য অনুচিত বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। যাই হোক, ব্রহ্মা এবং ইন্দ্র প্রধান সময় নাট্যশাস্ত্র তৈরী হচ্ছে এটুকু আমরা বুঝতে পারছি।
সঙ্গে শিবের যোগদান আবশ্যক হয়ে পড়েছে যখন, এও বোঝা যাচ্ছে যে ইন্দো ইরানীয়ান ইন্দো ইউরোপিয়ান গোষ্ঠীদের সঙ্গে তথাকথিত অনার্যদের একধরণের বিনিময় স্থাপিত হয়েছে যে সময় সেই সময় এই অংশের উদ্ভব। যদিও নাট্যশাস্ত্রের নাট্যোৎপত্তি কাহিনীতে প্রত্যক্ষত শিবের অবদান খুব সামান্য। সেখানে কৈশিকী বৃত্তি প্রয়োগের কথায়, ভরত বলছেন, তিনি শিবকে দেখেছেন এই বৃত্তি প্রয়োগ করতে। নারীরা ছাড়া এ বৃত্তি বহন করা সম্ভব নয়। সে কথা শুনে ব্রহ্মা অপ্সরা সৃষ্টি করে দিলেন ভরতকে। অর্থাৎ শিবের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এ কাহিনীতে আসেনি শুরুতে। সুতরাং বলা চলে যে তথাকথিত আর্য বলয়ে আর্য দেবতাদের প্রাধান্যের সময়কে এই নাট্যোৎপত্তির কাহিনী চিহ্নিত করছে।
এবারে আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। নাট্যশাস্ত্রের উৎপত্তি প্রসঙ্গে ডঃ কীথ মন্তব্য করেছিলেন যে সামগ্রিক হিন্দু সমাজের ত্রিদেবকেই এই শিল্পের উৎপত্তির সঙ্গে জোড়া হয়েছে। তা যে হয়নি তা আগেই লিখেছি। আরেকটি কথাও লেখা প্রয়োজন। সামগ্রিক হিন্দু সমাজ বলতে আজ আমরা রাজনৈতিকভাবে যা বুঝি তা তখন ছিল না। হিন্দু বলতে যে একটি ধর্ম বোঝায় এমন কোনো ধারণাও ছিল না। বেদানুসারী ঐন্দ্র্য থেকে বৈষ্ণব – বেদবিরোধী জৈন, বৌদ্ধ, আজীবকাদি শ্রামণিক মতাদর্শ – চার্বাকদের মতন নাস্তিক – আবার বেদানুসারীদের মধ্যেও দার্শনিক বিভেদাদি – এমত হাজারো বিভাজনে বিভক্ত সময়কাল ও সমাজ। শৈব, শাক্ত, অন্যান্য জনজাতীয় ধর্মাদি সে সবও জড়িয়ে আছে এই সময়কালের মধ্যে। কীথ জাতীয় পণ্ডিতেরা ইউরোপে জায়মান নিজেদের আর্যতত্ত্বের চাপে হিন্দু শব্দটিকে বেশ আলগা করে যেখানে ইচ্ছে প্রয়োগ করে কিছু সমস্যা বাড়িয়েছেন।
সমস্যা আরো বেড়েছে কীথের এই মত, মনমোহন ঘোষ অথবা আই শেখরের মত পণ্ডিতেরা আরো বহুদূর নিয়ে যাওয়ায়। যেমন মনমোহন একদা শুরু করেছিলেন নাট্যোৎপত্তির এই কিংবদন্তীটি খুবই খারাপ ভাবে বানানো গল্প আরো খারাপ ভাবে প্রক্ষিপ্ত করা, এই মতবাদ দিয়ে। পরে সরে গিয়েছেন নাট্যশাস্ত্রের প্রাগার্য উৎপত্তির তত্ত্বে। শিবের পূজার সঙ্গে সংযোগ ইত্যাদি দিয়ে তিনি এ তত্ত্ব প্রমাণে এগিয়েছিলেন। এ তত্ত্বকে আরো দূরে নিয়ে গিয়েছেন আই শেখর।
তাঁর বক্তব্য, ভরতকে নাট্যের দৈবী উৎপত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে। মুখ্য, গৌণ দেবতাদের তুষ্ট করার (মুখ্যত তাঁদের পূজকদের) সঙ্গে তাদের পছন্দের নানা বিষয় আনতে হয়েছে নাট্যে। সংহিতাগুলি থেকে নানা উপকরণ ধার করে একে পঞ্চম বেদ বানাতে হয়েছে। নইলে ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছে উপেক্ষিত থাকতো। সব বর্ণকে আনন্দ দেবার জন্য নাট্যশাস্ত্র তৈরী। বিশেষ করে শূদ্রের যেহেতু বেদে অধিকার ছিল না তাই নাট্যশাস্ত্র কাজে এসেছে। এইভাবে অনার্য শিল্পী, নট-অভিনেতাদের জায়গা করেছেন ভরত। সব নাট্য যা ভরত প্রযোজনা করেছেন বলা হচ্ছে, সে সবই দেবতাদের পক্ষে। সে কারণে ব্রাহ্মণদের কাছে এই নাট্যের উপকারী চরিত্র অথবা ক্ষতিকর নয় এমন চরিত্র প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়েছে। আনুকূল্য এসেছে।
অর্থাৎ নাট্যের উৎপত্তির সঙ্গে আর্য তত্ত্বের রাজনীতি থেকে ব্রাহ্মণ্য-শূদ্র দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সবই জড়িয়ে গিয়েছে এই সকল আলোচনায়। এক্ষেত্রে আমরা কি এই পরিসরের বাইরে থাকতে পারব? সম্ভব নয়। কারণ নাট্যশাস্ত্রের উৎপত্তির কাহিনীই শুধু নয়, সমগ্র নাট্যশাস্ত্র জুড়ে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ইত্যাদি রাজনীতি জড়িয়ে আছে। সেক্ষেত্রে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেখানে যেখানে দেবরাজ ইন্দ্র জনসমাজ (শাসিত সমাজ)-এর জন্য দৃশ্য-শ্রাব্য একটি বিষয় চাইছেন, যেহেতু বৃহদাংশের (নারী অনুল্লিখিত ওখানে বলে এখানে মনে করা আবশ্যিক যে তাদেরও বেদ পাঠে অধিকার চলে গিয়েছে তখন) সমাজে চলনের জন্য জ্ঞান প্রয়োজন। কী ধরণের জ্ঞান? অবশ্যই আচরণীয় জ্ঞান। তা আসবে ইতিহাস-পুরাণাদি থেকে। সেখানে দেবতাদের বা ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য, ক্ষত্রিয়ের মহত্ব ইত্যাদি বর্ণিত থাকবে। সমাজে নানা বর্ণের ভূমিকা সম্পর্কে পর্যালোচনা থাকবে কাহিনী-কাঠামোর মধ্যেই। অর্থাৎ একটু বাড়লে আমরা বলতে পারি ধর্মশাস্ত্রগুলি শ্রুতি এবং স্মৃতির বিষয়, তাকে যদি কাহিনী দিয়ে ব্যাখা করা হয় যা দৃশ্যপোযোগী তাহলে নাট্যশাস্ত্রের সম্ভাবনা তৈরী হয়।
এইখান থেকে যদি দেখা হয় তাহলে নাট্যশাস্ত্রের উদ্দেশ্য যে শুধুই আনন্দদান নয়, তা পরিস্কার হয়ে ওঠে। আনন্দদানের অনুষঙ্গে শাসনের যা দর্শন তাকে চারিয়ে দেবার একটি পরিকল্পনাও নাট্যশাস্ত্র। এই সমালোচনা সত্ত্বেও এ আলোচনাতে যে কথা স্পষ্ট করা ভাল, যে কোনো শাস্ত্রই কোনো না কোনো পক্ষ অবলম্বন করে থাকে। দেখার বিষয় শুধু এই হওয়ার কথা নয়, বরং দেখার বিষয় হওয়া দরকার সেই শাস্ত্রটি কত সফল নিজের কাজে।
এই কথাটিকে ধরার আগে আমাদের নাট্যোৎপত্তি ও দেব এবং বেদ-এর সম্পর্ক আরেকটু খতিয়ে দেখার প্রয়োজন। প্রথমত আমরা বেদ-এর দিকটিকে দেখে নিই। নাট্যোৎপত্তির কিংবদন্তী বলছে ব্রহ্মা চার বেদ থেকে চারটি বিষয় নিয়ে এই পঞ্চম বেদ সৃষ্টি করেছেন। এ কথার তাৎপর্যকে বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের অভিনবগুপ্তের আশ্রয় নিতে হবে। বা বলা চলে আশ্রয় নিতে হবে প্রাক্তন সময়কালের সৃষ্টিতত্ত্বের। শতপথ ব্রাহ্মণে সৃষ্টিতত্ত্বের কথা একটু জেনে নিই আমরা। সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি চারপাশে যা কিছু সৃজিত সব দেখলেন। তারপরে তাকে তিনভাগে ভাগ করলেন। সেই তিনভাগকে নিজের মধ্যে স্থাপন করলেন। এই কাহিনী অবশ্যই অতিকথা। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয়, বেদ সম্পর্কে ভাবনাটি এভাবে গড়ে উঠছে। অর্থাৎ বেদের মধ্যে সাধারণ থেকে অবাঙমানসগোচর অবধি চিন্তনকে ধরার একটি প্রক্রিয়া আছে ব্রাহ্মণ সাহিত্যে। অবশ্যই বেদবাদী তৎকালীনদের ভাবনা এটি। কিন্তু একে অনুসরণ না করলে আমরা কেন বেদ থেকে নাট্যের উপাদান নেওয়া হচ্ছে সে কথা অনুধাবন করতে পারব না। ত্রিবেদ-চতুর্বেদ সমস্যার সমাধান যদিও এখানে নেই, তবু একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই দৃষ্টিকে অনুসরণ করেই অভিনবগুপ্ত চলছেন।
অভিনবগুপ্ত ‘বেদসংহিতা’ সম্পর্কে টীকা করতে গিয়ে ‘নাট্য’ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। তিনি বলছেন নাট্য ত্রিবর্গ বা চতুর্বর্গ ধরে সকল পুরুষার্থ সাধন করে। নাট্যের মাধ্যমে মানুষ অধর্ম পরিত্যাগ করে। এই প্রসঙ্গেই আমাদের অধুনাতন অতীতের একটি কথা স্মরণে আসতে পারে, ‘নাটকে লোকশিক্ষা হয়’। অর্থাৎ অভিনবগুপ্তের যে পদ্ধতি তা যদি আমরা লক্ষ্য করি, দেখব একটি নির্দিষ্ট জীবনযাপনের নিয়মনীতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নাট্যের আগমন। যা নাট্যোৎপত্তির যে উপাখ্যান তার সঙ্গে সাযুজ্যই রেখেছে। পরবর্তী অংশে আমরা প্রাথমিক নাট্য এবং নাট্যশাস্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে নেব। তার থেকে অনুমান করা যাবে শিক্ষা বলতে কোন ধরণের শিক্ষা এবং কেমন ভাবে তা প্রবর্তিত হচ্ছে।