থিয়েটারের আঙিনায় কিছু কথা – পর্ব ৪ – তুষার ভট্টাচার্য

।৷ ৬৮ নং বিডন স্ট্রিট ।।

এমারেল্ড, ক্লাসিক, কোহিনূর, মনমোহন, অরোরা, এই নামগুলো সব একটাই থিয়েটার বাড়ির নাম, তার নাম ‘স্টার’। একটাই ঠিকানা ৬৮ নং বিডন স্ট্রিট।

আজকের দিনে ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটের ‘থিয়েটার বাড়ি’র বদলে সেখানে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ আর বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থল। আর ওই নাট্যশালার উঠোনের যে শিবলিঙ্গকে কুশীলবেরা প্রণাম করতেন সেই শিবলিঙ্গ ছাড়াও একটা স্মারক সেখানে দেখতে পাবেন। ১৯৩১ এ ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের উন্নয়নের ঠেলায় এই নাট্যশালা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

এই থিয়েটারের নাম হবার কথা ছিল ‘বি- থিয়েটার’। কেন হয়নি, কীসের জন্যে হয়নি, কী বৃত্তান্ত এসব তো আপনারা জানেন।

কম বেশি সব মানুষই রামকৃষ্ণ- গিরিশ- বিনোদিনী-গুর্মুখ, স্টার… এসব জানেন। তবু আবার এই প্রসঙ্গে আজ আসছি কেন? স্টার, গিরিশ, বিনোদিনী… এঁদের নিয়ে তো বারবার কথা বলাই যায়।

এই ‘স্টার’কে ঘিরে কত ঘটনা। আর সেই ঘটনা নিয়ে অনেক যাত্রা, নাটক, সিনেমা, গল্প… লেখা হল, অভিনীত হল, ভবিষ্যতেও হবে। থিয়েটার যতদিন থাকবে ‘বি-থিয়েটার’ নিয়ে আলাপ আলোচনা চলতেই থাকবে।

এই ৬৮ নং বিডন স্ট্রিট জমিটা ছিল বাগবাজারের কীর্তিচন্দ্র মিত্রের। এঁকেই অভিনেত্রী বিনোদিনী ‘প্রিয় মিত্র’ বলেছেন। উনিশ শতকের শেষদিকে বিডন স্ট্রিটের বনমালী চক্রবর্তীর ভাড়া বাড়িতে গিরিশবাবুর নেতৃত্বে রিহার্সাল হতো। কীর্তিচন্দ্রবাবুর থেকে এই ৬৮ নং জমি লীজ নিয়ে গুর্মুখ রায় ‘স্টার থিয়েটার’ তৈরির পরিকল্পনা করলেন।
জমি হল, নাট্যশালা বানানোর জন্যে যে টাকা লাগবে, সেই টাকা দেবার লোক পাওয়া গেল। কীভাবে টাকা পাওয়া গেল সেটা তো ইতিহাস।

আমি অন্য কথায় যাচ্ছি। এখন, কীভাবে সেই নাট্যশালা তৈরি হবে, মানে স্টেজ কোথায়, কী সাইজ, গ্রীনরুম, দর্শকদের বসার জায়গা ইত্যাদি তো করতে হবে। তার জন্যে তো একটা বিল্ডিং প্ল্যান দরকার। ওই আমরা যেমন আমাদের বাড়ির জন্যে প্রফেশনাল লোক দিয়ে প্ল্যান বানাই। এই থিয়েটার বাড়ির প্ল্যান তৈরি করলেন স্টেজ ম্যানেজার প্রফেসর জহরলাল ধর।

এই থিয়েটার বাড়ির খরচপত্র যা হচ্ছিল, তারও তো একটা হিসেব রাখা দরকার না কি? সেই হিসেবপত্র দেখার জন্যে গিরিশবাবু ভার দিলেন হরিপ্রসাদ বসুকে। গিরিশবাবুর যাওয়া আসার পথে চিৎপুর রোডে ওঁর একটা ডাক্তারখানা ছিল। তাঁর হিসেবপত্র রাখার দক্ষতা দেখে গিরিশবাবু এই কাজে তাঁকে নিয়োগ করলেন। ইনি পরে স্টার থিয়েটারের ক্যাশিয়ার এবং অন্যতম অংশীদারও হয়েছিলেন।

স্টারের থিয়েটার বাড়ি হয়ে গেল। এই থিয়েটার বাড়িই কলকাতায় প্রথম ‘পাকা বাড়ি’র থিয়েটার। এর আগের যেসব থিয়েটার বাড়ি, যেমন বেঙ্গল থিয়েটার, গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার ইত্যাদি, সেগুলো ছিল কাঠের বাড়ি, মাথায় করগেট বা খোলার চাল। আমি ব্রিটিশদের তৈরি যেসব থিয়েটার হল তাদের কথা এখানে বলছি না কিন্তু।

স্টার থিয়েটার উদ্বোধন হল ২১ জুলাই, ১৮৮৩। প্রথম দিনের নাটক ‘দক্ষযজ্ঞ’। প্রসঙ্গত এই নাটক মঞ্চে অভিনয়ের আগে যে ফুল বা ড্রেস রিহার্সাল হয়েছিল, সেটা হয়েছিল কালীঘাটের নাটমন্দিরে।এই নাটকে কাঁচের ওপর আলো ফেলে দশমহাবিদ্যার আবির্ভাব ও তিরোভাব দেখিয়েছিলেন ওই প্রফেসর জহরলাল ধর। ‘ইণ্ডিয়ান ডেইলি নিউজ’ পত্রিকায় প্রথম রাতের বিজ্ঞাপন ছিল এইরকমঃ

Grand Opening Night./ Star Theatre / Beadon Strret/ Proprietor Baboo Goormuk Roy/ Saturday 21st July/ Baboo G.C.Ghose’s New Drama/ Dakshya Yajna/ Everything Grand & Wonderful/ G.C.Ghose, Manager.

স্টারে গিরিশবাবুর পর পর তিনটে নাটক – ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘ধ্রুবচরিত্র’ আর ‘নলদময়ন্তী’ আজকের ভাষায় ভীষণ হিট হয়েছিল। তিনটি নাটকেই বিনোদিনী অভিনয় করেছিলেন। গিরিশবাবু প্রথম নাটকেই শুধু অভিনয় করেছিলেন।

এইসব ফ্যাক্টস অ্যাণ্ড ফিগারস পড়তে বা জানতে বেশ ভালো লাগছে তো? মনটা কিরকম চলে যাচ্ছে না সেই কত বছর আগে? মনে হচ্ছে না, আহা যদি এসব একটু দেখতে পেতুম বা নিদেনপক্ষে আর একটু জানতে পারতুম…. সেইসব দিন… ঘোড়ার গাড়ি, গ্যাসের আলো, কনসার্ট…

গিরিশবাবু এবং তাঁর সহশিল্পীরা চার বছর রে রে করে এখানে তাঁদের নাটক করলেন। সময়টা ছিল ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৭, অসাধারণ সব নাটক এই সময়ে মঞ্চস্থ হয়েছিল। দক্ষযজ্ঞ দিয়ে শুরু হয়ে ধ্রুবচরিত্র, নল-দময়ন্তী, বুদ্ধদেব চরিত, বিল্বমঙ্গল, বেল্লিক বাজার, চৈতন্যলীলা প্রভৃতি। এ সবই গিরিশবাবুর নাটক। এরপর তো এই থিয়েটার বাড়ি ওঁদের ছেড়ে চলে যেতে হয়। সে আর এক গল্প। স্টার থিয়েটারে গিরিশবাবুদের শেষ অভিনয় হয় ৩১ জুলাই, ১৮৮৭, সেদিন ওঁরা করেছিলেন ‘বুদ্ধদেব চরিত’ আর ‘বেল্লিক বাজার’।

কবি স্যার এডুইন আর্নল্ডের ‘Light of Asia’ কাব্য অবলম্বনে গিরিশবাবু ‘বুদ্ধদেব চরিত’ নাটক রচনা করেছিলেন। এই নাটক উনি স্যার এডুইনকেই উৎসর্গ করেছিলেন এবং ‘ঋণী শ্রী গিরিশ্চন্দ্র ঘোষ’ লিখে বইতে স্বাক্ষর করেছিলেন। স্যার আর্নল্ড ১৮৮৫ র শেষের দিকে কলকাতায় এসে এই নাটক দেখেছিলেন এবং বাংলা নাটকের উন্নতির জন্যে গিরিশবাবুর যত্ন, উদ্যম ও অভিজ্ঞতার প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ততে তিনি লিখে গেছেন, “বঙ্গ-রঙ্গভূমির দৃশ্যপটাদি দেখিয়া বিলাতি থিয়েটারের অধ্যক্ষেরা যদিও হাস্য করিতে পারেন, কিন্তু গভীর ভাবসম্পন্ন নাটকাভিনয় ও অভিনয়-চাতুর্য্য দর্শনে তাঁহাদিগকে নিশ্চয়ই চমৎকৃত হইতে হইবে”।

প্রসঙ্গত ‘বুদ্ধদেব চরিত’ নাটকের গান— ” জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই, কোথা থেকে আসি কোথা ভেসে যাই” গিরিশবাবুকে অমর করে রেখেছে। এই গান স্বামী বিবেকানন্দর খুব প্রিয় গান ছিল। গভীর রাতে সিমলা স্ট্রিটের বাড়ির দালানে পায়চারি করতে করতে তিনি এই গান গাইতেন।

এই নাটক দেখে বাগবাজারের জমিদার নন্দলাল বসু বাড়ির পুজোয় বলি বন্ধ করে দেন।

গুর্মুখ রায়ের শখ মিটে গিয়েছিল। উনি বেহিসেবী খরচ করে অনেকগুলো মামলায় জড়িয়ে পড়লেন। বেনেটোলার কাঠ ব্যবসায়ী গদাধর দাস হাইকোর্টে কেস করলেন। স্টার থিয়েটারের স্টেজ করার জন্যে চার হাজার টাকার সেগুন কাঠ দিয়েছিল সে। ওই টাকা সে পায়নি, এই তার বক্তব্য। গুর্মুখ অস্বীকার করলেন গদাধরের বক্তব্য। বললেন, গদাধর খারাপ কাঠ দিয়েছিল আর হিসেবেও গণ্ডগোল করেছে। গুর্মুখের অ্যাটর্নি ছিলেন মিঃ গ্রেগরী আর গদাধরের অ্যাটর্নি সি.এফ.ম্যানুয়েল। গুর্মুখ হেরে গেলেন কোর্টে। সব টাকা তাঁকে শোধ করতে হল।

গুর্মুখ রায় এগারো হাজার টাকায় স্টার থিয়েটারের স্বত্ব বিক্রি করে দিলেন অমৃতলাল বসু, হরিপ্রসাদ বসু, দাসুচরণ নিয়োগী আর অমৃতলাল মিত্র’র কাছে। টাকা কে দিল থিয়েটার কেনার? গিরিশবাবুর উৎসাহে অমৃতবাবুরা জোগাড় করে আনলেন কয়েক হাজার টাকা। আর বাকিটা জোড়াসাঁকোর কৃষ্ণধন দত্তের কাছে ধার নিলেন তাঁরা। অমৃতবাবুরা চারজনেই ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষের শিষ্য। নাটক লেখার ব্যাঘাত হবে বলে তিনি এই থিয়েটারের অংশীদার হননি। উল্টে তাঁর শিষ্যদের স্বত্বাধিকারী করে তাঁদের আণ্ডারে চাকরি করতে লাগলেন।

গুর্মুখবাবু ১৮৮৩র শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এঁর পুরো নাম গুর্মুখ রায় মুসাদ্দি। ওঁর বাবার নাম গণেশদাস মুসাদ্দি। ইনি ছিলেন হোর মিলার কোম্পানির প্রধান দালাল। এঁরা এসেছিলেন রাজস্থানের মাণ্ডোয়া থেকে। গুর্মুখ রায়ের মায়ের নাম রূপা দেবী, স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী দেবী, দুই মেয়ের নাম পার্বতী আর বাসন্তী। বাইশ বছর বয়সে ১৮৮৬ সালে গুর্মুখ রায় মারা গেলেন বারাণসীতে। তখন এঁদের বাড়ির ঠিকানা ছিল ২৫, বড়তলা স্ট্রিট। এখন সেটার কী ঠিকানা জানিনা। বাড়িটা এখনও আছে কিনা তাও জানিনা।

আচ্ছা এসব তথ্য কি ‘বাহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়া’ হয়ে যাচ্ছে? সে হোকগে। কী আর করা যাবে!

ধনকুবের মতিলাল শীলের নাতি গোপাললাল শীলের মাথায় পোকা নড়ল থিয়েটার করবে বলে। টাকা আর প্রতিপত্তির জোরে ত্রিশ হাজার টাকায়, মানে টিনের তলোয়ারের বীরকৃষ্ণ দাঁ’য়ের মত একটা মাত্র জড়োয়া আংটির দাম দিয়েই গিরিশবাবুদের থেকে কিনে নিলেন ওই ‘স্টার’ থিয়েটার। নাম দিলেন ‘এমারেল্ড থিয়েটার’। সেটা ছিল ১৮৮৭ সাল।

স্টার ছাড়তে হল গিরিশবাবুদের। যে রাতে স্টার ছেড়ে শিল্পীরা চলে যাচ্ছিলেন, সেই রাতে স্টারের সব অভিনেতা অভিনেত্রী একটা গান গেয়ে দর্শকদের থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। দর্শকরা কাঁদছেন, অভিনেতা- অভিনেত্রী-কলাকুশলী সবাই কেঁদেছিল সেদিন।

এই স্টারেরই আরো কিছু টুকটাক খবর নিয়ে আজ এসেছি আপনাদের কাছে। শুনবেন তো?

এই যেমন ধরুন শ্রীরামকৃষ্ণ ওই স্টারে নাটক দেখেছিলেন। এ তো আমরা জানি। সেই নাটকের নাম ‘চৈতন্যলীলা’ এও জানি। কবে দেখেছিলেন? তারিখটা ছিল ২১সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪, আচ্ছা উনি কি ওই একবারই স্টারে নাটক দেখেছিলেন? না, না, আপনাদের কোনো প্রশ্ন করছি না। নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করছি। ভাববেন না যেন, আমি কাউকে আণ্ডার এস্টিমেট করছি। আসলে আজকের এই ‘চাপ’ আর মোবাইলের যুগে তো আমাদের বই পড়া, চিঠি লেখা এসব প্রায় উঠে গেছে, তাই এই লকডাউনে বই থেকে একটু এসব ঝালিয়ে নিচ্ছি। ব্যস আর কিছু নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু আরও দু’বার নাটক দেখেছিলেন স্টারে। ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসের চব্বিশ তারিখে তিনি দেখেছিলেন ‘প্রহ্লাদ-চরিত্র’। আর পরের বছর ১৮৮৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে তিনি দেখেছিলেন ‘বৃষকেতু’ আর অমৃতলাল বসু’র ‘বিবাহ বিভ্রাট’। এই মানুষ নাটক দেখেছিলেন বলেই নাটকের নামে সমাজের নাক সিঁটকোনো বন্ধ হয়েছিল।

গোপালবাবু পয়সা আর প্রতিপত্তি দেখিয়ে স্টার তো কিনে নিলেন, নাম দিলেন ‘এমারেল্ড থিয়েটার’। প্রথম নাটক ‘পাণ্ডব নির্বাসন’। না, জমল না সে নাটক। আরে বাবা, পয়সা-প্রতিপত্তি থাকলে অনেক কিছু হয়, অনেকের মাথা কেনা যায়, আনডিউ কিছু অ্যাডভান্টেজও পাওয়া যায়, কিন্তু শিল্প সৃষ্টি হয়না। ওটা বাবা অন্য জিনিস! গোপালবাবুর মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল, নাটক জমাতে হবে। কী করা যায়! ভাঙা পয়সা দিয়ে গিরিশবাবুকে ভাঙিয়ে আন। গিরিশবাবুকে বললেন, আপনি যদি না আসেন আমার থিয়েটারে, তাহলে আপনার বাকি সব শিল্পীকে টাকা দিয়ে কিনে নেব। কী আর করবেন গিরিশবাবু! কুড়ি হাজার টাকা বোনাস আর সাড়ে তিনশ টাকা মাইনে নিয়ে পাঁচ বছরের চুক্তিতে অমৃতবাবুদের কাছ থেকে এমারেল্ডে এলেন গিরিশবাবু। না, সবাইকে বার করে আনতে পারেননি গোপালবাবু।

ওদিকে অমৃতবাবুরা তখনকার ৭৫/৩ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট মানে এখনকার হাতিবাগানে নরেন্দ্রকৃষ্ণ দেবের থেকে তিরিশ কাঠা জমি সাতাশ হাজার টাকায় কিনে ফেললেন। এবার থিয়েটার বাড়ি বানাতে হবে। টাকা চাই। গিরিশবাবু যে নিজেকে বিক্রি করলেন গোপালবাবুর কাছে কুড়ি হাজার টাকায়, সেই টাকা থেকে বিনা শর্তে ষোল হাজার টাকা তুলে দিলেন অমৃতবাবুদের হাতে। কুড়ি হাজার টাকাই দিতে চেয়েছিলেন উনি। নিজের ভাইয়ের বাধায় সেটা পারেননি। শুধু তাই নয়, এই সময়ে তো গিরিশবাবু এমারেল্ড থিয়েটারে ম্যানেজারের পদে নিযুক্ত হয়েও অমৃতবাবুদের জন্য নাটক লিখে দিয়েছিলেন। পাছে গোপাললাল শীল জানতে পারে তাই তিনি খালধারে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে লালপাড় শাড়ি পরে এসে মহিলা সেজে নাটক লিখেছিলেন। সেই নাটকের নাম ‘নসীরাম’। লেখক ‘সেবক’। এই নাটক দিয়েই নতুন স্টারের উদ্ধোধন হয়েছিল। সে দিন ছিল ২৫ মে, ১৮৮৮ সাল।

পাঁচ মাসের মধ্যে দেড় হাজার মানুষ বসতে পারেন এমন একটা থিয়েটার হল বানিয়ে ফেললেন অমৃতবাবুরা। যাঁর নাম হল ‘স্টার থিয়েটার’। কী করে হল এই নাম? স্টার নাম ছিল তো ওই ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটের থিয়েটার বাড়িটার!

স্টার থিয়েটারের স্বত্তাধিকারীরা গোপালবাবুর কাছে থিয়েটার বাড়িটা বিক্রি করেছিলেন, কিন্তু ‘স্টার’ নামের গুডউইল কিন্তু বিক্রি করেন নি।

তাই নতুন থিয়েটার বাড়ি যার সেদিন ঠিকানা ছিল ৭৫/৩ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট তার নাম হল ‘স্টার’। মানে আজ যাকে আমরা দেখি হাতিবাগানে। এই থিয়েটারে কিন্তু বিনোদিনী অভিনয় করেননি বা শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ এখানে নাটক দেখেননি । কিন্তু বিনোদিনী এখানে অনেকবার নাটক দেখতে এসেছিলেন। এই নতুন স্টারেরও অনেক অনেক গল্প, চোখের জল, অনেক নতুন শিল্পী, কোর্টকেস… শুনতে ইচ্ছে হলে হুকুম করবেন।

আমরা ছিলাম তো ওই পুরোনো ‘স্টারে’। সেখানেই ফিরে যাই। ওই থিয়েটারে অসংখ্য মানুষ ছাড়াও নাটক দেখেছেন বঙ্কিমচন্দ্র, ফাদার লাফোঁ, এডুইন আর্নলড, কর্নেল অলকট প্রভৃতি বিখ্যাত মানুষেরা।

যেদিন ফাদার লাফোঁ ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে এসেছিলেন, সেদিন নাটকের মাঝপথে বিনোদিনী অজ্ঞান হয়ে যান। ড্রপসিন পড়ে যায়। ফাদার গ্রিনরুমের ভেতর চলে যান। গিরিশবাবুকে বলেন, “চলো, আমি একবার দেখিব”। বিনোদিনীর যখন জ্ঞান এল, উনি দেখলেন লম্বা দাড়িওয়ালা এক সাহেব তাঁর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বিনোদিনী উঠে বসলেন। গিরিশবাবু বললেন, “এঁকে প্রণাম করো ইনি পণ্ডিত ফাদার লাফোঁ”। বিনোদিনী তাঁকে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। ফাদার তাঁর মাথায় হাত দিয়ে এক গ্লাস জল খেতে বললেন। জল খেয়ে আবার অভিনয়ের জন্যে প্রস্তুত হলেন বিনোদিনী। উনি বলেছেন, অন্যদিন অজ্ঞান হয়ে গেলে কেমন নিস্তেজ হয়ে যেতাম। কিন্তু এইবারে সেটা আর হয়নি।

এমনিতে যখন কোনো সাহেব সুবো নাটক দেখতে আসতেন, সেদিন দর্শক বেশি হতো। এ কি ওই সাদা চামড়ার প্রতি আমাদের বিশেষ আকর্ষণ?

চৈতন্যলীলা নাটকে নিমাই সন্ন্যাস নিয়ে মা শচীদেবীর থেকে বিদায় নেবার সময় বিনোদিনীর সংলাপ শুনে অনেক দর্শক চিৎকার করে কেঁদে উঠতেন। বিনোদিনী বলেছেন, ওই কান্না শুনে আমার বুকের ভেতর গুরগুর করত। জগদগুরু শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই নাটকের অভিনয় দেখতে দেখতে ভাবে বিভোর হয়ে দর্শক আসন থেকে উঠে নেচেছিলেন। এই নাটক স্টারে প্রথম অভিনীত হয়েছিল ২ আগস্ট, ১৮৮৪ সালে।

প্রসঙ্গত বড়লাট লর্ড এবং লেডি ডাফরিন এবং ছোটলাট স্যার অগাস্টাস রিভার্স টমসন প্রসিদ্ধ জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে তখনকার স্টার থিয়েটারের নাটক অমৃতলাল বসু-র ‘বিবাহ-বিভ্রাট’ নাটকটি দেখেছিলেন। (এই সেই জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়, যাঁর কাণ্ড কারখানা থেকে নাটক, সেই নাটক থেকে ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল’ – সেসব অন্য কথা) সেই নাটকে মিঃ সিনহা সেজেছিলেন স্বয়ং রসরাজ অমৃতলাল বসু, মিসেস কারফর্মা- বিনোদিনী, ঝি- ক্ষেত্রমণি। লেডি ডাফরিন এদেশ থেকে চলে যাবার পর যে আত্মকথা লিখেছিলেন, তার নাম ‘Our Viceregal Life In India’। সেই আত্মকথার ১৮৫৫ সালের ২৩ জানুয়ারি, সোমবারের পাতায় তিনি ‘ক্ষেত্রমণি’র ঝি’ চরিত্র নিয়ে লিখেছিলেন – ” The best actor was a maid-servant who seemed to say very sharp things and when she and her mistress who had a disagreement the scolding on both sides was loud & stormy”. আর ছোটলাট স্যার অগাস্টাস বলেছিলেন, ” So powerful an artist can scarcely be seen even in a London Theatre of these days”.

এই স্টার থিয়েটারেই বিনোদিনী শেষ অভিনয় করলেন ‘বেল্লিক বাজার’ নাটকে রঙ্গিনীর ভূমিকায়। সেদিন ছিল ২৬ ডিসেম্বর, ১৮৮৬ সাল। ২রা জানুয়ারি স্টার থিয়েটার একুশ দিনের জন্যে মফস্বলে শো করতে বেরিয়ে পড়ল। মানে আজকের ভাষায় ‘কল শো’ করতে। মফস্বলে কোথায় কোথায় কী কী নাটক করেছিলেন, সেটা আমি জানিনা কিন্তু। তবে অন্য একটা তথ্য এর বদলে দিচ্ছি। নতুন স্টারের মানুষেরা একবার রেঙ্গুনে শো করতে গিয়েছিলেন। এটা অহীন্দ্র চৌধুরীদের সময়। সালটা ঠিক বলতে পারছি না। স্টারের ডিমাণ্ড ছিল জাহাজ ভাড়া, খাওয়াদাওয়া ছাড়া পার শো হাজার টাকা। উদ্যোক্তারা বলেছিলেন, সাড়ে সাতশো। ওঁরা তাতে রাজী হয়েছিলেন।

ওঁরা মফস্বলে গেলেন আর তার আগের দিন ১লা জানুয়ারি, ১৮৮৭ সালে বিনোদিনী ‘স্টার থিয়েটার’ ছেড়ে চিরকালের মত চলে গেলেন। এরপর উনি প্রায় চল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন। কিন্তু আর কোনোদিন তিনি অভিনয় করেননি।

ওই যে ওঁরা নিজেদের ‘স্টার থিয়েটার’ ছেড়ে হাতিবাগানে নতুন করে ‘স্টার থিয়েটার’ তৈরি করলেন, সে একমাত্র ‘স্টার’ এর গুডইইল গোপালবাবুর কাছে বিক্রি করেননি বলেই। জানিনা, ওঁরা ওই জায়গা ছেড়ে চলে আসার সময়ে সঙ্গে কী কী নিয়ে এসেছিলেন। একটা জিনিসের কথা জানতে পেরেছি যেটা তাঁরা সঙ্গে করে এনেছিলেন। সেটা একটা ‘আলো’।

তখন ফ্লাড লাইটিং বা ইলেকট্রিসিটি অত চালু ছিলনা। দু একটা ব্রিটিশ দোকান যেমন কুক অ্যাণ্ড কেলভি বা হ্যামিলটনের বাড়ি ইলেকট্রিক আলো দিয়ে সাজানো হতো। অন্য জায়গায় ছিল ঝাড়ের কলসী, কৃস্টাল ড্রপস কলসি বা তারা। তাতে তার দিয়ে নানারকম ডিজাইন করা।

বিশেষ করে রাজবংশের এমব্লেম থাকত সেসব আলোতে – ‘Ich-Dien’ এর ভেতরে আলো দিয়ে জ্বালানো হতো। মনে হতো যেন অনেক রত্ন একসঙ্গে জ্বলছে।

ওই আলোগুলোতে মুকুটের মত থাকত, অনেকটা Ich- Dien এর মত, সেই মুকুটের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ত আলোর ঝরণা। ( Ich-Dien – এটা জর্মন প্রতিশব্দ। এর অর্থ “আপনার সেবায় আমি”। তিনটে পালকযুক্ত এক মোটো এই Ich-Dien, যা ওয়েলশ-এর রাজঘরানার প্রতীক)

এইরকম জিনিসের তৈরি বড়ো একটা তারা, তার ব্যাস হবে পাঁচ থেকে আট ফুট – তারার ফলকগুলো বেঁকানো বেঁকানো, এই পুরোনো স্টার থিয়েটারের মাথায় জ্বলত। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বহু মানুষ এই আলো দেখতেন। এই ‘আলো’ অমৃতবাবুরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।

এই ‘আলো’ তাঁরা লাগিয়ে দিয়েছিলেন নতুন স্টার থিয়েটারের মাথায়। সেখানেই জ্বলত এই আলো। অনেক পরে স্টারের এই আলো বোধহয় আপনারা অনেকেই দেখেছেন।

এই নতুন স্টার চলতে চলতে একসময়ে তার অবস্থা খারাপ হয়। তখন আর এই আলো জ্বালানো হতো না অনেক কারেন্ট পুড়বে বলে।

সেই আলো ধোয়ামোছা করে আবার জ্বালানো হল স্টারের মাথায় ‘দি আর্ট থিয়েটার লিমিটেড’ এর পরিচালনায় ৫ই শ্রাবণ, ১৩৩০ অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘কর্ণার্জ্জুন’ নাটকের প্রথম শোয়ের সন্ধ্যায়।

One thought on “থিয়েটারের আঙিনায় কিছু কথা – পর্ব ৪ – তুষার ভট্টাচার্য

Comments are closed.