একটি জীবন মানে একটি অসামান্য ভ্রমণকাহিনি। যে কোনও জীবন। শালিকের, দোয়েলের, শেয়ালের, মানুষের বা প্রজাপতির।
জীবন সৃষ্টি থেকেই তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসতে শুরু করে। অর্থাৎ আরও সহজ করলে বলা যায়, এক একটা সময় চলে যাওয়া মানে মৃত্যুর সময়ের কাছে এগিয়ে যাওয়া। শুধু, যে সময়টা চলে যায় তাকে বারকয়েক অথবা বার বার রোমন্থন করতে পারি আর কী। আর মানুষ নামের সর্বশেষ সৃষ্ট প্রাণীটির কাছে রোমন্থন বড় আকর্ষণের, তা সে দুঃখের হোক বা সুখের। এভাবেই আমাদের ফেলে আসা অতীত আমাদের জাগিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে এমনকি উত্তেজনার রসদ সরবরাহ করে। এমন রসদ যা শুয়ে ছিল গভীরতার অন্য স্তরে। তাকে স্পর্শ করতেই বিদ্যুতের মত চমক ছুটে যায় সারা শরীর জুড়ে। রেলগাড়ির মত ছুটে চলে রক্ত লসিকা কোশ থেকে কোশান্তরে। এভাবেই যাযাবর প্রজাতির লেখা হয় অন্য ইতিহাস। অন্য অভিজ্ঞতার আখ্যান। আমাদের যাযাবর জীবনের নানা রং-বর্ণ-শব্দ-গন্ধ-স্বাদ মিলেমিশে পৌঁছে যেতে চায় কোনও দিকশূন্যপুরে আর তখনই সৃষ্টি হয় প্রকৃত ভ্রমণবৃত্তান্ত।
আস্তাবলের ঘোড়া চাবুক খাওয়ার আগেই নিজের দৌড় যাচাই করতে চায় কখনও কখনও আর সেই অছিলায় ঢুকে পড়ে পরীদের রাজ্যে যেখানে অপেক্ষা করে থাকে ফুলপরী, জলপরীরা। কুঁড়ি থেকে ধীরে ধীরে ফুলের যাবতীয় রং-রূপ ঝরে পড়ে পাতায় পাতায়। সেখান থেকেই আমার যাত্রার শুরু।
সেই কবেকার সময়, ভুলে যাওয়া, প্রায়-ভোলা, আলো-অন্ধকারকে এপাশ-ওপাশ থেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে এসেছি এতটা পথ, যার সবটা যে নাটককে ভেবে বা ভালবেসে তা নয়। তবে কোনও এক শুরুর শুরু বা তারও শুরুর শুরুয়াৎ হয়েছিল কাছের মানুষদের সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতা আর বোধের মিশেলে। যা সঞ্চালিত হয়েছে পরম্পরার হাত ধরে আমার গভীরে, আমাদের গভীরে। এভাবেই ছাড়িয়ে থাকা সংস্কৃতির চিকন সুতোর বাঁধন আমাকে পাক দিয়ে নিয়ে ফেলল থিয়েটারের উঠোনে। উঠোন জুড়ে পাখপাখালির ডানা-ঝাপট আর উড়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা। আদতে তা নেশা। আমিও একদিন এইসব পাখিদের আস্তানার বাসিন্দা হলাম আর উড়তে লাগলাম। যত উড়ি তত আনন্দ। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম সব কিছু ভুলে গেলাম। ক্লান্ত শরীর। বিশ্রাম নিলাম যৎকিঞ্চিৎ। আবার ওড়া। এ গ্রাম-সে গ্রাম, এ পাড়া-ও পাড়া উড়তে উড়তে যতবার ডানা ক্লান্ত হয় ততবার টের পাই আমি বা আমার মত পাখিরা ডানায় বহন করছি সময়ের ইতিহাস। তখনই সেই ইতিহাসকে লিপিময় করে তুলি, ডানা হালকা হয়, উড়ে চলি। অনেক সময় লম্বা সফর। যে সফরে আরও রং। যা মাখামাখি হয় শরীরে। রেণুর মত ঝরে যায় সময়ের যাত্রাপথে। দূর থেকে দেখি, হয়তো আমারই মত কোনও অচেনা মানুষ সে-সব কুড়িয়ে নিয়ে সযত্নে রাখছে নাটকের ডালিতে।
এভাবেই কখনও হালকা কখনও ভারি ভারি সময়ের হাত কাঁধে নিয়ে থিয়েটারের এই বিরাট, বিপুল মহাসমুদ্রের কয়েক মুঠো জল তুলে এনে আপনাদের হাতে দিতে চাওয়া, এই আর কী।
এতে কি তৃপ্তি মেটে?
এক –
আমাদের গ্রামের নাম মেদিয়া। ছোট একটি গ্রাম যাকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে নাম দেওয়া হয়েছে। সুভাষনগর, সতীন সেন নগর, অকবীনিনগর ও রবীন্দ্রনগর। আমাদের বসবাস সুভাষনগরে, যেটি গ্রামের মূল প্রবেশপথের শুরুতে। অর্থাৎ কাছের মফস্বল শহর বা টাউন এবং রেলওয়ে স্টেশন গোবরডাঙার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছে। আমাদের গ্রামটির বেশিরভাগ বাসিন্দাই উদ্বাস্তু। গত শতকের স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা মানুষের বসবাস এখানে। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাও আছেন অনেকে। গ্রামটিকে সম্পূর্ণ ঘিরে আছে মনোরম প্রাকৃতিক সম্পদ, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ‘কঙ্কনা’, যার স্থানীয় নাম কঙ্কনা বাঁওড়। এই গ্রামকে কেন্দ্র করেই আমাদের বেড়ে ওঠা। এখানকার সংস্কৃতিই আমাদের জীবন গঠনের সম্পদ হয়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বামপন্থী আন্দোলন ও সমাজ গঠনে বাবার (অজয় ভট্টাচার্য) নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগঠনের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল পার্শ্ববর্তী গোবরডাঙা ও আমাদের গোটা বসিরহাট মহকুমা অঞ্চলে। ফলে মেদিয়া গ্রামটি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকলেও সাংস্কৃতিক চেতনা ও বোধ নির্মাণে ছিল অগ্রগণ্য।
আটের দশকের শেষভাগ থেকেই আমি পারিবারিক সংস্কৃতির সূত্রেই যুক্ত হয়ে যাই নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। সে সময় রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী হলে পাড়ায় পাড়ায় লেগে যেত আয়োজনের ধুম। এক সন্ধ্যায় এ পাড়া থেকে পাশের পাড়ায় ছুটে বেড়ানো যেন এক অন্য অভিজ্ঞতা। আমাদের একটা শ্রুতিনাটকের সংস্থা ছিল ‘সৃজনী’ নামে। নিয়মিত বড়দের অভিভাবকত্বে চলত অনুশীলন। নাট্য উৎসব বা অন্য অনুষ্ঠানে সৃজনীর শ্রুতিনাটক সমাদর পেয়েছে বহুবার। নয়ের দশকে শুরুর দিকে সমাজকর্মী দাদা মৃণাল বিশ্বাস উদ্যোগ নিলেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবায় একটি অনুষ্ঠানে আমরা যাব শ্রুতিনাটক অভিনয় করতে। আমার মা, দিদি সহ অন্যান্য কলাকুশলীরা চললাম। সে এক রোমাঞ্চঘন অভিজ্ঞতা। গোবরডাঙা থেকে রেলপথে শিয়ালদা। তারপর শিয়ালদা দক্ষিণ শাখায় ক্যানিং লোকাল ধরে সোজা ক্যানিং। তারপর ভটভটিতে বাসন্তী হয়ে গোসাবা। সে সময় গোসাবা গঞ্জে বিদ্যুৎ ছিল না। জেনারেটরের ব্যবস্থা করেছিলেন আয়োজকরা। আমাদের শ্রুতিনাটক পরিবেশন ও স্থানীয় মানুষ, দর্শক, দোকানিদের বিস্ময়ভরা চোখ-মুখ ও জিজ্ঞাসা আমার আজও মনে আছে। শোনা গেল তাঁরা এর আগে যাত্রা শুনেছেন, যেখানে অভিনয় হয়। পালা শুনেছেন, সেখানেও অভিনয় হয়। কিন্তু এ নাটকে কোনও অভিনয় দেখা গেল না। এ কেমন নাটক? এ তল্লাটে নাকি এমন নাটক প্রথমবার হল। আমরা যেমন বিস্মিত, তেমনই গর্বিত হলাম। রোমাঞ্চের আরও বাকি ছিল। সে রাত্রে আয়োজক সংস্থা আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করেছিল বিখ্যাত হ্যামিল্টন বাংলোতে। হ্যাঁ, হ্যামিল্টন সাহেবের অবদান গোসাবা-সুন্দরবন অঞ্চলে সুবিদিত। সেই মানুষটির বাসস্থান সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি বাড়িটিতে আমরা সে রাত কাটাই। সেদিন মোমবাতির আলো ছিল আমাদের সঙ্গী। এক অন্যধরনের রোমাঞ্চ ছিল আমাদের চোখেমুখে। শুনেছি এই কাঠের বাংলোটি হ্যামিল্টন সাহেব সম্পূর্ণ বানিয়ে তাকে পার্ট করে নিয়ে এসেছিলেন জাহাজে চাপিয়ে। সে রাত্রে ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছি। ছড়িয়ে রয়েছে কত অজানা ইতিহাস। টেবিল, আলমারি, বাথটব আরও কত কী। সম্পূর্ণ অবহেলায়। জানি না তারপর কী হয়েছে! তবে নাটক পরিবেশন করতে গিয়ে এমন ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক দুর্লভ পাওনা। যে অভিজ্ঞতা আমাকে আজও গর্বিত করে।
দুই –
সেটা গত শতকের আটের দশকের শেষ দিক হবে। আমাদের গ্রামের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা। আয়োজন করে মেদিয়া সাংস্কৃতিক চক্র। যে সংগঠনের সূচনাকাল থেকে আমার বাবা ছিলেন সভাপতি। এই প্রতিযোগিতাটি মেদিয়া সহ আশপাশের অঞ্চলের (এমনকি গোবরডাঙার পর্যন্ত) মানুষের কাছে বিনোদন ও সংস্কৃতির অন্যতম আয়োজন। ফলে প্রতিদিন তাঁবুভরে দর্শক উপস্থিত থাকেন। মূলত জানুয়ারি মাসের শুরুর সপ্তাহে ভরপুর শীতের আমেজ গায়ে মেখে শিল্পী-বিচারক-দর্শক-সংগঠক সকলে উপভোগ করেন এই আয়োজন। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের স্বনামধন্য নাট্যদলের প্রযোজনা দেখার সুযোগ হয় আমাদের। আটের দশকের শেষভাগ, মানে, আমি তখন স্কুলে পড়ি। ফলে আমার দায়িত্ব ছিল স্বেচ্ছাসেবকের। আহ্বায়কের কঠোর নিয়মে চলতে হত আমাদের। তবে আমার বাড়ি যেহেতু অনুষ্ঠানস্থলের গা-ঘেঁষে এবং বাবা যেহেতু সভাপতি, ফলে সামান্য হলেও অবাধ যাতায়াত ছিল বিভিন্ন দিকে।
এই প্রতিযোগিতার বিচারকদের বেশিরভাগই আসতেন কলকাতা থেকে। মানে তখন তাঁরা আমাদের কাছে নক্ষত্রসম। স্থানীয় নাট্যজনও থাকতেন খড়ের বিছানা পাতা আসনে। যারা কলকাতার বা দূরের বিচারক ছিলেন তাঁদের রাত্রিবাসের জায়গা ছিল আমাদের বাড়ি। বাড়ির বারান্দা লাগোয়া ছোট ঠাকুরঘরের চৌকিতে তারা বসতেন। আমি এবং পরিবারের অন্যরা তাদের জন্য বিভিন্ন পরিসেবা প্রদান করে নিজেদের ধন্য মনে করতাম এবং পরবর্তীতে বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় কিছুটা credit নিতাম। সেইসব মাননীয় বিচারকদের সঙ্গে আমার পরবর্তী নাট্যজীবনে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক, যাঁদের মধ্যে অন্যতম রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ দাস। দ্বিতীয়জন বর্তমানে প্রয়াত।
যখন কোনও নাট্যদল তাদের requisition-এ নানা ধরনের প্রপার্টি চাইত এবং তার মধ্যে অনেক কিছুই আমাদের বাড়ি থেকে নিতে হত, সেই দায়িত্ব পালন করতে পেরে আমার ভীষণ আনন্দ হত। ওই সব জিনিসের মধ্যে ছিল ফুলসহ ফুলদানি, টি-টেবিল, বইয়ের তাক, মগ, বালতি, চায়ের কেটলি, কাপ-ডিস, গ্লাস, থালা, কিছু সরু-মোটা বই, প্লাস্টিকের জলের জগ, বেতের মোড়া এইসব আরও কত কী। সেসব তিনদিন ধরে অনুষ্ঠানমঞ্চের পিছনে গোডাউনে পড়ে থাকত। শেষদিন আবার বাছাই করে নিয়ে আসতাম বাড়িতে। বেশিরভাগটাই পাওয়া যেত। কিছু কিছু পাওয়া যেত না অথবা ভেঙে যেত। বাড়িতে মা সামান্য ঝামেলা করলেও সব মেনে নিতেন। আবার আমি অপেক্ষায় থাকতাম পরের বছরের নাটকের আয়োজনের জন্য।
এ সব তো আমাদেরই জীবনের কথা। বড় ভাল লাগছে।