ঘূর্ণি: দ্বিতীয় মৌলিক নাট্যরচনা
রবিবারের সকাল, দেনেন মুখুজ্জের পরিবারে ৫ জন মানুষ – অসুস্থ স্ত্রী বীণা, দুই মেয়ে খুকু আর সুমি এবং ছেলে প্রণব। তিনি নিজে একটা পত্রিকার এডিটর। প্রণব গান করে লঘু সুরে, সিনেমায় গাইবে কিংবা ঢুকে পড়বে কারখানায়। জঙ্গি গান গেয়ে উঠবে ‘মজদুর হ্যায় হাম’ কিংবা unite, nothing to lose but your shain, আদর্শের নিষ্ঠা নেই। শেষে বিদ্রুপে ভরা গণনাট্য-কর্মী যেন! আদর্শহীন ভোগবাদী পঙ্গু সমাজের যাবতীয় আবর্জনা সরিয়ে ফেলে শোষণমুক্তির স্বপ্ন দ্যাখে আরেক চরিত্র বিকাশ। শ্রেণীহীন সমাজ গড়বে! তার কল্পনা : সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথেই আসবে মুক্তি! বিকাশের কন্ঠে লম্বা লম্বা সংলাপের মিছিল, বক্তব্যের ভারে নাট্যগতি শ্লথ হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক জটিলতার আবর্তে নাট্যকার নিজেই বিপর্যস্ত। দরিদ্র অসহায় শিক্ষক নিজের মেয়েকে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োগ করার দালাল! তীব্র পচন আর পতন! গ্রামে গিয়ে তেভাগা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে বিকাশ। কৃষি বিপ্লবে ঝাঁপ দিতে গিয়ে দৃষ্টিশক্তি হারায়। খুকু পালিয়ে যায় সমীরের সঙ্গে। দূর পাড়াগাঁয়ে আদিবাসী সান্নিধ্যে খুকু গর্ভবতী হয় – তার শরীরে আদিবাসী সন্তান। সমীরের ছিল ২১ খানা বাড়ি! ধ্রুপদী গানের অনুরাগ। সে ভালোবাসে খুকুকে; খুকু ভালোবাসে বিকাশকে; সুমি ভালোবাসে সমীরকে – এই রকম শ্যামবাজারী নাট্য-প্রযোজনায় ঘূর্ণির কাহিনী গড়ে ওঠে। অনেক বছর বাদে জুন ১৯৯৬ এ নাট্যের ভূমিকা লেখেন শম্ভু মিত্র : ‘মানুষের তৈরি সেই মন্বন্তর। লক্ষ লক্ষ লোক না খেতে পেয়ে শহরের রাস্তায় মারা গেল ৪৩ সালে। তারপর ৪৬ সালে বীভৎস দাঙ্গা হল হিন্দু মুসলমানের। …সেই আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থেকেছে। আজ পর্যন্ত। প্রথমেই শোনা গেল এ আজাদী সত্য নয়, এটা মিথ্যা। এই যেন হল স্মর্ধিত প্রগতির কথা। ট্রাম জ্বালানো ট্রেন ওড়ানো পুলিশের গুলি চালানো…, পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসীর প্রাথমিক সভ্য নিয়মগুলো দেশের লোক বুঝবার আগেই অ্যাসেম্বলিতে চটি ছোঁড়াছুড়ি হতে লাগলো। এরই পটভূমিকায় এবং নাট্যপ্রযোজনার একটা নতুন ভঙ্গী আবিষ্কারের চেষ্টায় ঘূর্ণি লেখার কষ্টকর প্রচেষ্টা। ঘূর্ণি লেখা শুরু হয়, যতদূর মনে পড়ে ১৯৫০ সালের শুরুতে, বোম্বের এক হোটেলের নির্জন ঘরে। … তারপরের বছর বোধ হয় একটা কঠিন ব্যাধিতে শয্যাগত হবার পর এ নাটক শেষ হয়। কিন্তু যে প্রয়োগ কৌশল মনের মধ্যে আসল তা ঠিকমত রূপ পাচ্ছিল না।’
নাটককারদের লেখার সময়ে — অনেক সময়েই এক বা একাধিক অভিনেতা বা অভিনেত্রী তাঁদের চোখের সামনে থাকে। যেমন পড়া যায় বার্নাড শ’র কিছু নাটকে ছিল, সার্ত্রর নাটকেও ছিল এবং অনেকেই অনুমান করেন যে শেক্সপীয়রের নাটকেও ছিল। … আমার মনের মধ্যে ছিল দেবেন্দ্র হবেন মহর্ষি; অবিনাশ-কালী সরকার মশাই; সমীর-সবিতাব্রত দত্ত; প্রণব-শোভেন মজুমদার; খুকু-শ্রীমতী তৃপ্তি মিত্র এবং তারিণী মাস্টার করার জন্য বিজনকে বলবো। পার্কের মধ্যে মহর্ষি ও বিজনের দৃশ্যটা যেন আমি দেখতে পাই। কিন্তু এ নাটক আমি কখনো অভিনয় করাইনি।’
পুনশ্চ
সম্ভবত ‘আওয়ার ইন্ডিয়ার’ শুটিং চলাকালীন ঘূর্ণি লিখছিলেন তিনি। উলুখাগড়ার অভিনয় ও ঘূর্ণি রচনা একই বছরে। ঘূর্ণি প্রথমে মুদ্রিত হয় সাহিত্য পত্রে; এরপর বহুরূপীতে। গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৬৫ সালে। তেভাগা আন্দোলনের ৫০ বর্ষ পূর্তিতে এস.সি.সরকার অ্যান্ড সন্স প্রকাশ করেন ‘প্রারম্ভিক’ – জুন ১৯৯৬ সালে। তাতে ‘উলুখাগড়া’ এবং ‘ঘূর্ণি’ সংকলিত হয়। আরো বিস্তৃত তথ্য ১৯৬৫ পর্বে। শঙ্খ ঘোষ লিখছেন : ‘একটা দৃশ্য’ সম্পূর্ণ না হবার কারণটা যেন বোঝা যায় তখন, এই নতুন নাটকটিরই মধ্যে একরকমের দেহান্তর পেয়ে গেছে সে, সে-নাটকেরই বাবাটি যেন দেখা দিয়েছেন ঘূর্ণির তারিণী চরিত্রের নাম নিয়ে।
ঘূর্ণির তারিণী মাস্টার বলেন : ‘পোলাগুলারে শিখাইছি plain living high thinking. বুনা রাম ছাগলের কথা শিখাইছি। বিদ্যাসাগর মহসীনের কথা শিখাইছি। আর আজ সেই পোলাগুলারে রাস্তা থিক্যা নিয়া যাই মাইয়াডার কাছে। জীবনের চাহিদা মিটাই।’ এই আরেক নাটক যেখানে বাড়ির মেয়েটির স্বগত গান : ‘শুধু অকারণ পলকে’ থেকে হঠাৎ পাল্ট যায় ভিন্ন এক আবৃত্তিতে ‘রাত্রি অন্ধকার। মৃতদানবের অক্ষিকোটরে মতো।’ … এর নায়ক ইতিহাসে বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়; যে ইতিহাস ‘ব্যক্তির সমগ্রের’ …
— রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে tussle?
কালের প্রতিমা ।। ১৯৫০ (বোল্ড হবে)
কোরিয়ায় কম্যুনিস্টদের তীব্র লড়াই।
স্তালিনের বিশ্ববিজয়ের আশা প্রতিহত করতে মার্কিণী তৎপরতা, সুপারিশ।
শেয়ালদা স্টেশনে কুড়ি হাজার উদ্বাস্তুর সংসার। কলেরায় প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যু; পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা … সংখ্যালঘু নির্যাতন …অস্থির পশ্চিমবঙ্গ… দেশ জুড়ে খাদ্য সংকট … দ্রব্য মূল্যের দাম বৃদ্ধি… মধ্যবিত্তের তীব্র হাহাকার উদ্বাস্তু বিক্ষোভ … ট্রেন আক্রমণ … পুনর্বাসন সমস্যায় সরকার ব্যর্থ… কম্যুনিস্টদের সম্পর্কে পন্ডিত নেহরুর অবিচলিত মনোভাব। আসামে ভূমিকম্প : গৃহহীন ৫০ লক্ষ মানুষ!
২০.০২.১৯৫০ বিপ্লবী শরৎচন্দ্র বসু মারা গেলেন। ২৮.০২.১৯৫০ তে অভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ী। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেলেন ০১.০৯.১৯৫০, এবং অরবিন্দ ঘোষ ০৫.১২.১৯৫০ ইহলোক ত্যাগ করলেন ।
নাট্যচক্র প্রযোজিত বিজন ভট্টাচার্য নির্দেশিত নীলদর্পণ অভিনয় ২৭.৮.১৯৫০, বিজন ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠা করলেন ক্যালকাটা থিয়েটার। একাংক নাটক লিখলেন ‘জননেতা’ ও ‘কলঙ্ক’। গণনাট্য সংঘ প্রযোজনা করছে বীরু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঢেউ’। অভিনয় হয়েছিল যাদবপুর কলেজ হোস্টেলের ছাদে – ঋত্বিক ঘটক সেজেছিলেন বৃদ্ধ কৃষক। এ বছরই ঋত্বিক ঘটক লিখলেন এবং অভিনয় করালেন ‘জ্বালা’। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নিরঞ্জন সেন অনুরোধ জানালেন উৎপল দত্তকে। এল. টি. জি থেকে দুজনকে নিয়ে তিনি গণনাট্য সংঘের মধ্য কলকাতা শাখার যোগ দিলেন। এই সময়টায় তিনি এলটিজিতে করাচ্ছিলেন ও ডেটস-এর টিল দ্যা ডে আই ডাই — নিষিদ্ধ এক কমিউনিস্ট পার্টির আমৃত্যু সংগ্রামের কাহিনী।
দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘মোকাবিলা’ প্রকাশ। পাঞ্জাব থেকে ফিরে পানু পাল লিখলেন তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভাঙ্গাবন্দর – তিনিও অনুরোধ করলেন উৎপল দত্তকে ইংরেজি নাটক না করে গণনাট্যে যোগ দিতে। গণনাট্যে যোগ দিলেন এবছরই শচীন সেনগুপ্ত। তাঁর ‘অস্তরাগ’ একাংক বেরুলো।
ওই বছরই অর্থাৎ ১৯৫০ সালে পেশাদারী মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় চলছে : আত্মদর্শন/মিনার্ভা; কল্যাণী/কালিকা; বিজয়া/শ্রীরঙ্গম; শেষরক্ষা/শ্রীরঙ্গম; যুগদেবতা/কালিকা; উর্বশী/স্টার; সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত, চাঁদ সদাগর / মিনার্ভা; পরিণীতা/স্টার;
ক্রমশ…