একটা গোটা পাতা ভর্তি জুতোর বিজ্ঞাপন। পুজোয় চাই বাটা। ব্যালেরিনা জুতো ভেসে বেড়ায় তাতে।সঙ্গে ড্যান্সিং ফ্রক। সাদা ফ্রিল দেওয়া। কিন্ত তাকে ব্যালেরিনা দেওয়া হয় না। প্লে মেট পরতে হবে।বেল্ট দেওয়া প্লেমেট। হিল তোলা চটি বা জুতো পরা চলবে না। কিন্ত তার খুব শখ হয়।সে বলতে পারে না। তাকে আবারো আবারো প্লেমেট পরানো হয়।অথবা কেডস।
আমার পুজো একেবারেই জামাকাপড়ের ছিল না। পুজো মানে বই। সারাবছর বই কেনার অভ্যেস তখন থেকেই। কিন্ত পুজোর বই আর জন্মদিনের বই স্পেশ্যাল। নববর্ষের বইও ছিল । দুতিনটে নতুন জামা শরতের আকাশে মেঘের মতো ভাসতোই। সেটা নিয়েও খুব একটা মাথা ঘামানো নেই । ষষ্ঠীতে নতুন জামা, পয়লা বৈশাখে নতুনের চল ছিল না বাড়িতে।তার কারণ আমার পুরোপুরি নাস্তিক পিতৃদেব। কখনো মন্দিরে যেতে দেখিনি। অঞ্জলি দিতেন না। তাই আমিও ঐ পথে… জামাকাপড়ের বাড়াবাড়ি একদম পছন্দ করতেন না।আবার মা পুজো দিলে আপত্তিও করতেন না। দু’ জন দুইজনের মত, নিজস্ব মতে । বরং ঘরোয়া লক্ষ্মী বা সরস্বতী পুজোতে যা যা চাইতেন মা, সবকিছুই কেনা হত। কিন্ত পুজোর কোনো এলাহি স্রোত কখনো গায়ে এসে লাগেনি কারণ বাবার তাতে যোগ থাকতো না। শহুরে ঘ্রাণ এবং কংক্রিটের রাস্তাতে পুজো মানে পুজোর গান। রেকর্ড আসতো এইচ এম ভিতর । আমাকে বোঝানো হয়েছিল তা হল পুজোর নান্দনিক দিক অ্যাপ্রিশিয়েটকরা। সামাজিক দিক অ্যাপ্রিশিয়েট করা। আসলে আমাদের ছোটবেলায় শরতের আকাশ সত্যিই ঝকঝকে ছিল। মেঘ অনেক সাদা , শ্বেত ভল্লুকসমএবং কালীপুজোর সময় হিম পড়তো। পুজোবার্ষিকী বেরোতো পুজোতেই এবং আট ন’বছর বয়স থেকেই যথারীতি দুপুরবেলা আমি সব জাতীয় পুজোসংখ্যা গিলে যেতাম।দেশ, নবকল্লোল, কৃত্তিবাস সহ যা যা আসতো বাড়িতে । ঐ বয়সে যা যা পড়ার কথা নয়, তাও পড়তাম। দীপালি দত্তরায়ের “লাল নীল সবুজ আলো নেই” ঐ বছর নয়েক বয়সে পুজোতে পড়ে ফেলি। এখন বুঝি, অমন সাহসী লেখা এখনও দুর্লভ।ফেলুদার জন্য অপেক্ষা ছিল, বিমল কর, রামপ্রসাদ চৌধুরির টান খুব অল্প বয়সে। এবং শীর্ষেন্দু।
বাবার অভ্যেস ছিল ঘুমন্ত আমার মাথার পাশে পুজোবার্ষিকী রেখে দেওয়া। আমাদের প্রজন্ম “আনন্দমেলা”-র জন্ম দেখেছে। সন্দেশ আসতো। শুকতারা। পুজোবার্ষিকী “কিশোরভারতী ” প্রাণ। এখনও সেইসব বই রাখা আছে। পুজো আমাকে দিয়েছে নাম তার ভাবা, ঘর ছাড়া রুণু, কায়না! খুব খুব সাধারণ পোশাক হত আমার। নো টিপ।নো চুড়ি। নো দুল। কলেজে ওঠার আগে এইসব একেবারে নিষিদ্ধ। স্কুল এবং বাড়ি, দু জায়গাতেই। নখে রঙ, ঠোঁটে রঙ তো ভাবাই যায় না।তবে হ্যাঁ, প্রতিবছর গরমকালে আর পুজোতে চুল কাটানো হত সেলুনে গিয়ে। নো লম্বা চুল।বহুকাল অবধি পুজোয় বয়জ কাট নিয়ে থেকেছি।
আমাদের পাড়ার পুজো মানে আদি বালিগন্জের পুজো। এটা ভীষণ সত্যি যে অমন সুন্দর ডাকের সাজ আর দেখিনি! অষ্টমীর সকালে একবার মা অঞ্জলি দিতে যেতেন, আর একবার দশমীর বিকেলে। তাছাড়া পুজো প্যান্ডেলের সঙ্গে আমার, আমাদের কোনও যোগ ছিল না। আমি ঘুরে বেড়াতাম কর্ণেল আত্তিলিও গত্তির সঙ্গে মিশরের আনাচে কাণাচে ভয়াবহ কোন গুহাতে বা রুণুর ময়মনসিংহর বাড়িতে। দেবসাহিত্য কুটিরের পুজোবার্ষিকীটাও এসে যেত। কী যে ভালো নারায়ণ দেবনাথের আঁকা ছবিগুলো ছিল ! একদম পুজো পুজো।কিশোরভারতীতে ইন্দ্রজিৎ রায়ের গোয়েন্দগল্প! আহা!
বইয়ের পরে যেটা পুজো পুজো ব্যাপার ছিল সেটা হল আহার। রেস্তঁরা বাহিত শৈশব নয়। লুচি তরকারি জলখাবারে, দুপুরে মাছের দুতিন পদ। অ্যাডেড অ্যাট্রাকশন তখন বাড়িতে যখন তখন আত্মীয় সমাগম, বাবা মায়ের বন্ধু সমাগম। পুজোতে শুধু তিনজন বসে খাচ্ছি মনে পড়ে না। আমাদের ছোট্ট ডাইনিং টেবলে কুলোতো না। শতরন্চি পেতে মাটিতে বসতাম। সাধারণত মাসি, মেসো, ভাই, মায়ের মামারা, কোনো পিসি। সন্ধেবেলা বাবার বন্ধুরা সপরিবারে।
প্রচন্ড প্রচন্ড খেলাধুলো তখন। আনন্দোৎসব টুপ টুপ করে ঝরে পড়তো। হিসেববিহীন। আমাদের পাড়ার ঠাকুর বরাবর একচালার। ট্র্যাডিশনাল মানে তখন বুঝিনা। প্যান্ডেলের বাহার নেই অতো। প্রতিমা আছেন তাঁর সন্তানদের নিয়ে। সন্ধ্যারতি আছে। বন্ধুর বাড়ির বারান্দায় বসে ধুনুচি নাচ দেখা যায়। কাছে যাওয়া বারণ। আগুন ছিটকে আসতে পারে। হুল্লোড়বাজদেরও ভরসা নেই। এত শাসনবারণ অধ্যুষিত পুজোতে মুক্তি ছিল একটাই।
ঐ ক’দিন পড়তে হবে না! কী ভারহীন আনন্দ! অষ্টমীর সন্ধেতে বন্ধুরা জানালো কে কটা পুজো দেখেছে।গুণতিতে কম হলে মুখ ভার। বাবা ডাবল ডেকারে চাপিয়ে একদিন গড়িয়াহাট থেকে শ্যামবাজার আর দশমীর দিন গড়িয়াহাট থেকে নাকতলা। বাস থেকে নামার নেই।জানলা দিয়ে যত প্রতিমা দেখা যায়, হয়ে গেল গোণা। আর যেটা হল হোর্ডিং পড়তে শেখা। ওটা কী লেখা আছে? পড়ো। বানান করো।ঐ করে প্রপার নাউনে ভুল হত না আর!
তবে পুজোর চেয়ে দশমীর আনন্দ কম ছিল না কিছু।না । কোনোদিন ঘাটে যাইনি। কিন্ত বাড়িতে শুরু হত নিমকী, গজা, দু তিন রকমের নারকেল নাড়ু, মিষ্টি মালপোয়া, ঘুগনি তৈরির প্রস্তুতি। বিজয়া একটা উৎসব ছিল। লক্ষ্মীপূজো আসছে। তারচেয়েও বড়ো বাড়িতে লোকজনের আনাগোণা। তিনজনের সংসারে অগণিত আত্মীয় বন্ধু এসে পড়তেন।ফোন করে আসার তো চল ছিল না তখন, ফোনই ছিল না !সকাল থেকে সন্ধে কেউ না কেউ এসে চলেছেন।লুচি ভাজা হচ্ছে। কেনা খাবারের গল্প নেই। মা যে কী করে অতটা সময় রান্নাঘরে কাটাতেন জানিনা। তবে পুজোর আসল আনন্দ আমাদের ছিল লোকজনের মধ্যে। সেইসঙ্গেই বাবা শুরু করে দিতেন পাড়ার নাটকের মহড়া। শারদোৎসব বা ডাকঘর। সন্ধেবেলা গান ভেসে আসছে, আমার নয়নভুলানো এলে ! কিংবা “আমার মনের ময়ূরমহলে” ।
পুজো মানে উৎসব। মানুষের উৎসব। আর দেবী আমার কাছে নয়নভুলানো। তাঁর সোনার নূপুর আমি প্রকৃতিতে খুঁজি।বরাবর। প্যান্ডেলের বাইরে।
পুজো নিয়ে স্মৃতি, স্মৃতির পুজো।
চমৎকার, ছোটবেলার স্মৃতি উসকে দিলেন আপনি। এসব গন্ধ এখনও অমলিন।
এখন শুধু ছোটদের দিনলিপি দেখে দেখে ফেরা, প্যান্ডেলের পাশ দিয়ে, খাবারের দোকানের পাশ দিয়ে, প্রথম প্রেমে পড়া ছেলেমেয়েদের আনন্দ দেখে ঘরে ফেরা।
লিখে ফেলা গানের মতো কবিতা।
Ghorey pherar gan.
শেষ লাইনটা মনে থাকবে। সোনার নূপুর তুমি প্রকৃতিতে খোঁজ!
আহা! কী ভাল লেখা!
অসাধারণ গল্প ছোট বেলার পুজোর ।