নটী বিনোদিনীর নাট্যকার চিত্তরঞ্জন ঘোষের কথায়– “আমার বিচারে সব মিলিয়ে ধরলে এই মুহূর্তে তৃপ্তি মিত্র ছাড়া কেয়ার সমস্তরের ‘ভালোমানুষ’ করবার মতো মহিলা এখন বঙ্গ মঞ্চে কেউ নেই “। মরু কেতনের মতো অমন উজ্জ্বল মুখের অভিনেত্রী সত্যিই আমরা কম দেখেছি বাংলা রঙ্গমঞ্চে।
৪০৬ রজনী অভিনীত ‘তিন পয়সার পালা’-র পারুলবালা, দিশারী পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘ভালোমানুষ’ এর শান্তাপ্রসাদ কেয়া চক্রবর্তীর জন্ম ৫ অগাস্ট ১৯৪২, উত্তর কলকাতার মানিকতলায় এক বনেদি পরিবারে। পিতার নাম অজিত চক্রবর্তী। বাগবাজার মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। মা লাবণ্যকে সন্দেহ করতেন বাবা। অশান্তি হত রোজ। তাই তাঁর চলে যাওয়া। কেয়ার যখন ৩ বছর বয়স তখন বাবা-মায়ের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়। কেয়ার তখন দিন কেটেছে তিন তলার বদ্ধ কুঠুরিতে। বাইরে যাওয়া মানে শুধুই স্কুল। দুই ভাই-বোন। বড় কেয়া, ভাই পল্টু চক্রবর্তী ৭০-র তোলপাড় সময়ে মারা যায়।
ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার মধ্যে বড় হতে থাকে সে। লেখাপড়া শুরু পাড়ার সরস্বতী নিকেতনে, পরে ব্রাহ্ম-বালিকা শিক্ষালয়ে। শ্যামবাজার বিশ্বভারতী লোকশিক্ষা সংসদ থেকে সঙ্গীত বিষয়ে কৃতিত্ব অর্জন। স্নেহবুভুক্ষু কেয়ার জীবনের প্রথম সাহিত্য রচনা ‘স্নেহ’। ১৯৬৩ তে কলেজ জীবনে বেতার নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম নিজের লেখা মৌলিক নাটক ‘কর্ণ’। অতিকঠিন বিকৃত শাসন ব্যবস্থা ছিল বাড়িতে। বাবা-মার দাম্পত্যের নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া বর্তেছিল তাঁর উপর। নির্জন-নিসঙ্গ পরিবেশ। সঙ্গী বলতে ছিল বই আর একটি কুকুর জ্যাকি। বিষণ্ণ ক্রুদ্ধ একটু বেশি স্পর্শকাতর, অল্পে বেদনার্ত ভেতরে ভেতরে একটা সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছিল, সেই সঙ্গে গড়ে উঠছিল ভবিষ্যতের কেয়া। তাই নিজের স্বাধীনতাকে ক্রমশ বাড়াবার চেষ্টায় বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি ও ১৯৫৯ এ প্রথম বিভাগে আই এ পাশ। ১৯৬৩ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ইংরেজিতে এম.এ উত্তীর্ণ। ওই বছরই শিক্ষকতা শুরু দমদম স্কটিশচার্চ স্কুলে ও ১৯৬৪ তে ইংরাজির অধ্যাপিকা পদে নিযুক্ত স্কটিশচার্চ কলেজে।
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ ২৯.৪.১৯৭১। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীর বছর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘চার অধ্যায়’ থেকে কেয়া চক্রবর্তীর নান্দীকারে প্রবেশ। প্রথম অভিনয় ১৯ মে ১৯৬১। অজিতেশ- অতীন, কেয়া-এলা। দুরূহ উপন্যাস, তরণ দলের দুঃসাহসিক প্রযোজনা। ৮টি আমন্ত্রিত শো। ঋণমুক্ত নান্দীকার। এবং মুক্ত মনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই দলেই অভিনয়। থিয়েটারের জন্য ক্রমশ বাড়তে থাকে ব্যস্ততা। ফলে ১৯৭৪ অধ্যাপনা পদে ইস্তফা। জীবনের প্রথম অভিনয় ছিল শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প থেকে ম্যালেরিয়া রোগীর চরিত্রে। কলেজে থাকাকালীন অখিল নিয়োগীর ‘সাঁঝের প্রদীপ’ নাটকে বেদেনীর ভূমিকায় অভিনয় করেন কেয়া। আরও অভিনয় ছিল – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভাড়াটে চাই’, চিত্তরঞ্জন ঘোষের ‘কন্যকা’য় কামিনী (১৯৫৮), ‘ত্রাহি’তে সুলতা (১৯৫৯), টংকাতংক’ তে মিনতি (১৯৬০)। পুরোপুরি অভিনেত্রী হবার কথা ভেবেছেন অনেক পরে।
প্রথমবার ১৯৬৬ তে নান্দীকার ভেঙে থেকে বেরিয়ে যান ১৪ জন বিদ্রোহী সদস্য। অজয় গঙ্গোপাধ্যায়, অজিত সরকার,অশোক মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, তাপসী গুহ, নিতাই ঘোষ, নিমাই ঘোষ, বিভাস চক্রবর্তী, বিমলেন্দু ঘোষ, মহেশ সিংহ, মানিক করায়চৌধুরী, মায়া ঘোষ, সত্যেন মিত্র, সৌরেশ দত্ত প্রমুখ। বেড়িয়ে এসে ১১ জুলাই ১৯৬৬ এঁরা গঠন করেন ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’। চাকরী ছেড়ে পেশাদার অভিনেত্রী হতে চেয়ে আর্থিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে তাঁকে। নান্দীকারের অর্থসংকট কালে উদ্ধারকর্ত্রী রূপে দলে আবির্ভাব। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু অর্থ দরকার ততটুকুও পাননি দল থেকে। নান্দীকারের অর্থসংকট কালে মায়ের গহনা বন্ধক দিয়ে দলের ভরসা জুগিয়েছিল। বেতারে চলচ্চিত্রে ছোট চরিত্রের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ১৯৭২ শম্ভু মিত্রের বিপরীতে ‘তুঘলক’ নাটকে ছোটআম্মা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বাংলা নাটমঞ্চ সমিতি প্রযোজনায় ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে অভিনয় করেন।
জীবনে মোট ৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় কেয়ার, রবীন্দ্রনাথের ‘ইচ্ছাপূরণ (১৯৬৯),পরিচালক : মৃণাল সেন, ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’ কাহিনী: রমাপদ চৌধুরী, পরিচালনা: অগ্রগামী, ‘প্রণয়পাশা’ কাহিনী: আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চিত্রনাট্য পরিচালনা মঙ্গল চক্রবর্তী, ছবিটি মুক্তি পায় ৯ জুন ১৯৭৮। অসমাপ্ত জীবনের শেষ ছবি ‘জীবন যে রকম’ কাহিনী: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পরিচালনা: স্বদেশ সরকার। এই চলচ্চিত্রের বহির্দৃশ্য শুটিং চলছিল সাঁকরাইলে গঙ্গা নদীর উপর, নৌকা থেকে ঝাঁপ দেবার দৃশ্য। অনভিজ্ঞ নির্দেশকের নির্দেশ পাওয়ার পরই নদীতে ঝাঁপ। প্রস্তুত ছিল না ডুবুড়ি, ছিল না ডামি চরিত্র। নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটিতেই এই দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু ১২ মার্চ ১৯৭৭,গঙ্গার পাড়ে অচেনা বারান্দাওয়ালা বাড়িটার উঠোন। মাথার কাছে তুলসী গাছ। হাওয়ার ঝরে পড়ছে তুলসী মঞ্জুরীর ফুল। ঠাসা মানুষের ভিড়। তার মাঝেই শেষশয্যায় রাখা মাঝনদীর গভীরে তলিয়ে যাওয়া অভিনেত্রী কেয়ার নিথর শরীর। বুকের ওপর আছড়ে পড়ে ডুকরে উঠছেন প্রৌঢ়া মা অনন্যা—’তুই যে বলেছিলি আমায় বুড়ো বয়সে দেখবি? কেয়া, কেয়া কথা বলছিস না যে! কথা বল, সাড়া দে…’। মেয়ের সারা শরীর ফুলে ঢাকা। কপালে চন্দন। মাথায় চওড়া সিঁদুর। সে দিকে তাকিয়ে কান্না-জড়ানো গলাতে অনন্যা বলে উঠলেন– ‘ওকে সিঁদুর পরালে কেন? ও এসব মানত না। এত ফুল! ওর লাগবে না তো!’ ১৪ মার্চ শহর জুড়ে সবার গন্তব্য সেদিন ছিল উত্তর কলকাতার ২০এ, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিট। সন্ধে নামার একটু আগে শববাহী কাঁচের গাড়িতে ওই বাড়ির সামনে আনা হল অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীকে। শ্যাওলা রঙা মুখটুকু তখন জেগে শুধু। সারা শরীর ফুলে মোড়া।
কেয়ার মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই নান্দীকারে আবার ভাঙ্গণ। কেউ কেউ বলেছেন কেয়া থাকলে হয়ত দল ভাঙত না। সব থেকে বড় ছিল তাঁর সততা, আন্তরিকতা, নিরপেক্ষতা, থিয়েটার সম্পর্কে কমিটমেন্ট, জনসাধারণের সম্পর্কে কমিটমেন্ট, তাই দিয়ে হয়ত ঠেকাতো। কেয়া ছিল নান্দীকারের বিবেক। আদর্শগত দিক থেকেও সদাজাগ্রত প্রহরী। নান্দীকারে শেষ অভিনয় ‘ফুটবল’ নাটকে মাসির চরিত্রে (প্রথম শো ১০ মার্চ ১৯৭৭ আকাদেমি)
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায়– ‘নাট্যকারের সন্ধানে দুটি চরিত্র’, ‘শের আফগান’, ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, ‘বীতংস’, ‘অগ্নিবিষয়ক সতর্কতা ও গৌতম’, ‘হে সময় উত্তাল সময়’, ‘শাহী বাদ’, ‘তিন পয়সার পালা’, ‘ভালো মানুষ’, ‘নীলিমা’, ‘চার অধ্যায়’, ‘রাত্রি’, ‘নটি বিনোদিনী’, ‘আলাের বাইরে’, ‘মূদ্রারাক্ষস, বৃত্ত’।
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর পরিচালনায়– ‘টক’, ‘আন্তিগোনে’, ‘ফুটবল’।
পরিচালক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেন ‘পূর্বরাগ’ নাটকে।
শম্ভূ মিত্রের পরিচালনায় ‘রক্তকরবী’, শ্যামানন্দ জালানের পরিচালনায় করেন ‘তুঘলক’ নাটকটি।
“ফুলের নামে নাম ছিল তাঁর। কেয়াফুল যেমন অন্য ফুলের থেকে আলাদা। অন্যদের থেকে কেয়া চক্রবর্তীও ছিলেন স্বতন্ত্র। ঘন সৌরভ ও শাণিত অস্ত্র। শ্মশানে কেয়াকে যখন ফুল চন্দনে সাজিয়ে লোহার বাসরে শুইয়ে দেওয়া হলো, শত শিখার নাগিনী তাঁকে দংশন করল, যখন আমাদের প্রাণ হাহাকার করে উঠল– আহা, ওঁর বড় লাগছে। তখন হঠাৎ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় কেঁদে চেঁচিয়ে উঠল— ‘কেয়া তোমায় ভুলবো না’, সঙ্গে সঙ্গে সেই হাহাকার সমবেত শোকগর্জনে ফেটে পড়ল— ‘কেয়াদি তোমায় ভুলবো না, তোমায় ভুলবো না’কেয়াদি, তুমি কাজ করতে করতে চলে গেলে, আমরা কাজ করতে করতে তোমাকে মনে রাখব’। এর অন্তরালে আর একটা শব্দ নিঃশব্দে বলা ছিল – তোমায় আমরা ভালোবাসি।