একটাই জায়গা কত তার নাম। মানভূম, বজ্রভূমি, পুরুলিয়া। যেন এক আদরিণী মেয়ে। এক এক পোশাকে বাড়ির লোকজন এক এক নামে ডাকেন, তার মিষ্টি পানা চাঁদ মুখের বৈচিত্র্যে। ১৯৫৬ সাল। নভেম্বরের গোড়ার দিক থেকে মানভূম মিলিয়ে গেছে পুরুলিয়া নামের মধ্যে। তবু এ অঞ্চলের মানুষ তাঁদের স্মৃতির পাতায় ওই নামটিকে একটা বড়ো জায়গা দিয়ে রেখেছেন। রাখবেনই বা না কেন! তাদের আদরিণী বিটিটার যে হরেক গুণ। সংস্কৃতির নানা রূপে সে সজ্জিত, সমৃদ্ধ। ফুটোফাটা ঘরে রাতের অন্ধকারে তারার সুন্দর রূপ দেখতে পাওয়া মানুষগুলি আর্থিকভাবে হয়তো সবাই সচ্ছল নন। কিন্তু সরস্বতীর হাত এঁদের মাথায় ঢেলে সাজিয়েছেন তাঁদের জীবনের আঙ্গিকের প্রতিটি ছন্দ-সুর-তাল। নিজভূমির প্রতি আত্মিক শ্রদ্ধাই প্রমাণ করে রুক্ষ মাটির আড়ালে সেই তুলতুলে আবেগের চিরায়ত প্রতিবেদনের কথা। কথা হল মাটির মানুষ বিশ্বনাথ দাশগুপ্তের সঙ্গে। পুরুলিয়ার চড়িদাতে ওঁর সঙ্গে বেশ কিছু কথা হয়েছিল। একবার লোকসংস্কৃতি সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি সম্পর্কে তখন অনেক কথা জেনেছিলাম।
এই অঞ্চলের অন্যতম লোকপরিবেশন পাতা নাচ। চোখের মনের প্রশান্তি আনা এই আঙ্গিকটি আমাকে তখনই নাড়িয়েছিল। যেন একসারি মাটি আঁকড়ে চলা কৃষ্ণ পিপীলিকা। সবাই সবাইকে বেঁধে বেঁধে রেখে একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেকের পায়ের ভঙ্গি এক। শরীরের বিভঙ্গের কৌণিক মাপগুলি সমান ডিগ্রিতে বাঁধা। বিশ্বনাথবাবু জানালেন, এই অনামী ছোটোনাগপুরের মালভূমিতে পাতা নাচ দুই কমিউনিটির মানুষ দুভাবে পরিবেশন করেন। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজন সারাবছর ধরে যে কোনো উৎসবে এই নাচ করে থাকেন। আনন্দ প্রকাশই হলো তাদের মূল কথা। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে পাতা নাচের মাধ্যমে। আর অপর যাঁরা মাহাতো বা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁরা করম বা জাওয়া পরব-এর মধ্যে এই নাচ করেন। গোটা ভাদ্রমাস জুড়ে চলে এর আসর। এটাই হল মূল কথা। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, অতিথির আগমন, পুজো এরকম যে কোনো উৎসব ঘিরে পাতা নাচ হয়। পাতা নাচ অর্থাৎ কোনো কিছু সম্পাদন বা উপস্থাপন। সারিবদ্ধভাবে যখন মেয়েরা একে অপরের হাত ধরে নাচে একে বলা হয় দাঁড় বাঁধা।
বোধহয় আনন্দের ওমটুকু একে অপরের মধ্যে এভাবেই তাঁরা চাড়িয়ে দেন, যেটা
এ নাচের মূল চালিকা শক্তি। ঢোল, ধামসা, রায়ড়ে (এক প্রকার তাসা) নানা বাদ্যে পাতা নাচের প্রতিটি পদ ছন্দে রেঙে ওঠে। পাড়ায় পাড়ায়, উঠোনে শালগাছের সামনে আনন্দে মাতোয়ারা রমণীদের নাচের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধামসা মাদল বাজিয়ে পুরুষেরা নাচের আসর মাত করেন। এ অঞ্চলে প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই রয়েছেন পাতা নাচের শিল্পীরা। কোটশিলা ঝুমুর আখরা, ধরতী-মার্শাল পাতা নাচের দল আরও কত। আসলে দল গড়বো বলেই এঁরা দল গড়েন না, হিমবাহের শীতলতার গলনেই নদীর প্রবাহে পাতানাচ উৎসারিত হয় এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষের মাধ্যমে। তবে বিশ্বনাথ বলেন সময়ের পরিবর্তন পাতা নাচেও ছোঁয়া দিয়েছে। শুধু আনন্দ নয়, ভাবের আদান প্রদানেও এ নাচ হয়। বাঁধা গানে শুরু হয় এ নাচ। তারপর শরীরের আনন্দটুকু নাচের মাধ্যমে ছেঁকে নিয়ে যেন মহুয়ার মাদকতার গন্ধ গোটা পাড়াময় ছড়িয়ে দিয়ে এ নাচ শেষ হয়। তখন বাঁধ ভাঙা আনন্দের ভঙ্গিমায় শেষ হয় এ নাচ। রাত কাবার হয়ে দিনের আলোও ফুটে যায় কখনো।
কথা হলো ধরতী-মার্শাল পাতা নাচ দলের অন্যতম সদস্য জগদীশ হাঁসদার সঙ্গে। জাহাজপুরের বাসিন্দা তিনি। তাঁর দলে রয়েছে ৩০ জন সদস্য। বাবা মতিলাল হাঁসদা। বংশপরম্পরায় এ নাচ তাঁদের রক্তে। ভূমিপুত্র এঁরা। মারাংবুরু-জাহেরায়ো দেবতাদের সামনেও এ নাচ তাঁরা করেন। তিনি জানালেন, এই নাচের জন্য বিশেষ এক ধরনের শাড়ি পরেন মেয়েরা। শাড়িটির নাম সিন্ধুয়া, উড়িষ্যা থেকে আসে। জগদীশ হাঁসদা বলেন, ‘আমরা তো সাঁওতাল মানুষ, আমরা গাছ, পাথরকে পুজো করি।’ তাঁর দাদার ছেলেমেয়েদের নামেই এই ধরতী-মার্শাল নাচের দলটি। শহরে এঁরা এ নাচ দেখাতে আসেন। তবে ব্যক্তিগত ক্লাব সংগঠন যে অর্থটুকু তাঁদের জন্য বরাদ্দ করে বর্তমান আর্থিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার পরিমাণ অনেকটাই কম। জগদীশ হাঁসদারা তবু ছুটে যান। আনন্দটা দেওয়াই তাঁদের একমাত্র বাসনা। তবে তিনি জানালেন নতুন প্রজন্মের ছেলেরা কিছুটা আধুনিক করে এ নাচ পরিবেশন করছে। কেউ অতটা নাচ শেখার জন্য আগ্রহীও নয়। নাচের মূল যে বাদ্য ধামসা, মাদল, রেগড়া, করতাল, বাঁশি, বানাম (কেন্দ্রি)–এর বদলে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক নানা বাদ্য। ফলে পাতা নাচের শিকড় খানিক আলগা হচ্ছে।
এখন সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ভাতায় তাঁরা তাঁদের বাদ্যযন্ত্রগুলিকে যত্নে রাখেন, রক্ষণাবেক্ষণ করেন। জগদীশ হাঁসদা জানালেন, যাঁরা পাতা নাচের গানের সিডি বানাচ্ছেন তাঁরা চটুল সব গানের সুর এই গানে আনছেন। একটু অতীত হাতড়ে তিনি বললেন তাঁর পূর্বপুরুষরা অসম থেকে এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। তিনি পাতা নাচ করেন ও পুরুলিয়ার মাটিতে ফসল ফলান। তবে যতই নতুনের ছোঁয়া লাগুক ১০০ জন মানুষের মধ্যে অন্তত ৫০ জন, এ নাচ চালিয়েই যাবেন, এই তাঁর বিশ্বাস। কারণ হিসেবে বলেন, ‘উৎসব মানেই যে পাতা নাচ, আর উৎসব আমাদের সব সময়ের সাথী’। উৎসবের আনন্দ জীবন থেকে ছেঁচে নিয়ে তাই এরা ‘ধাতিংদা তাংদা, হিতাংদা…’ মাদলের বোলে সর্বদাই নাচের জন্য প্রস্তুত।
দুরন্ত লেখা। ভালো লাগল।