অনুপম দাশগুপ্ত
আধুনিক যুগের রাষ্ট্রনীতিতে অস্ত্রের বাজার বজায় রাখতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা এখন এক নগ্ন সত্য। একবিংশ শতাব্দীর অবাধ উন্নয়ন আর টেকনোলজির অগ্রসরণ জন্ম দিচ্ছে নানাবিধ ভাইরাসের, আর উল্টোদিকে পুঁজিবাদ তার ফায়দা তুলছে ভ্যাকসিনের বিশ্বজোড়া বাজার বসিয়ে – এ এক অদ্ভুত vicious cycle। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে বিশ্বের ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থায় সবথেকে বেশী লগ্নি আসছে বেসরকারী সংস্থাগুলি থেকেই। পাশাপাশি ক্ষমতালোভীদের, সাধারণ মানুষকে নিরন্তর ইনজেক্ট করে চলা ঘৃণার বিষ, অসহিষ্ণুতার গরল তো আছেই।
এই কথাগুলোই আবার নতুন করে মনে করিয়ে দিয়ে গেল সোনারপুর উদ্দালকের নাটক নীল রঙের মানুষ। নাটক, নির্দেশনা ও মুখ্য ভূমিকায় পার্থ গোস্বামী।
আগাগোড়া একটি সাদামাটা উপস্থাপন অথচ কি গভীর তার অভিব্যক্তি, থিয়েটারের তথাকথিত আড়ম্বর ছাড়াই স্রেফ ভালো টেক্সট ও অভিনয়ের গুণে দর্শকদের বসিয়ে রাখল ৫০ মিনিট। এক আপনভোলা বর্ষীয়ান কেমিস্ট্রির প্রফেসর অচিন নন্দী, প্রায়শই রঙ নাম্বারে জেরবার সেই প্রফেসরের বাড়িতে একদিন উপস্থিত হয় এক ভদ্রলোক। প্রফেসরের এতাল বেতাল কথাবার্তায় সেই আগন্তুকের সাথে আলাপ যখন প্রায় প্রলাপের পর্যায়ে পৌঁছেছে, এমন সময় সেই ভদ্রলোক, জয়ন্ত দে জানান তিনি প্রফেসরের কাছে মারণ বিষ কিনতে এসেছেন। নড়েচড়ে বসে দর্শক, পরবর্তী কিছুক্ষণ সে স্বস্তি পায়না কারণ আপাত দৃষ্টিতে সেই ভদ্রলোকের ব্যক্তিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বজনীন এক সামাজিক সংকট, লোভ আর ক্ষমতার নেশায় মাতোয়ারা আজকের মানুষের জ্বলন্ত নিদর্শন।
আমরা সবাই কি একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছি না? মনের কোনে লুকিয়ে রাখি না তীব্র অসূয়া? আমাদের প্রত্যেকের অন্তরাত্মায় কি লুকিয়ে থাকে না কোন নির্মম খুনি? প্রকৃতি ও পরিবেশকে তিলে তিলে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে, প্রতিবেশীকে ঘৃণা করতে করতে, দুর্বল মানুষটিকে দাবিয়ে রাখতে রাখতে, পাশের মানুষটিকেও কখন যেন অচেনা ঠেকে। এই এক সমুদ্র হলাহল নিজেদের মধ্যে নিয়েও আমরা তবু খুঁজে বেড়াই একটুখানি বিষ। আর যখন সেই রিয়েলাইজেশন নাট্যদ্বন্দ্বের পরতে পরতে আয়না নিয়ে দাঁড়ায় আমাদের সামনে, তখন আমাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়, টলে ওঠে মাথা, আমরা পাগলের মতো খুঁজতে থাকি পরিত্রাণের উপায়, কোন জীবনদায়ী প্রতিষেধক। অবধারিত ভাবেই মুনাফালোভী বাজারের কাছে আত্মসমর্পন করতে হয় আমাদের, চলতে হয় তাদের অঙ্গুলিহেলনে।
নাটক দেখতে দেখতে কখন জানি বিগত দুই বছরের বাস্তব চোখের সামনে ভেসে ওঠে, পৃথিবীজোড়া মৃত্যুমিছিল আর বাঁচবার চরম আকুতি নিয়ে অসহায় মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে ভ্যাকসিনের দীর্ঘ লাইনে।
একদম নিরাভরণ মঞ্চে দুটি চেয়ার, একটি টুল, পিছনে আরেকটু উঁচু টেবিলে সেই টেলিফোন, সীমিত আলো এবং মৃদু আবহসঙ্গীত নাটকের মূল লক্ষ্য থেকে ঘাড় ঘোরাতে দেয় না। উল্লেখ্য মঞ্চ ও শিল্প নির্দেশনায় মঞ্জুলা গোস্বামী রায়ের এই পরিমিত ভাবনাকে।
নাটককার নির্দেশক নিজেই যখন মূল চরিত্রে অভিনয় করেন তখন নাটকের অন্তরবস্তুটি আরও ভালো ভাবে প্রতীয়মান হয়, নাটকের প্রথমার্ধের পাগলাটে প্রফেসর ধীরে ধীরে স্মার্ট তীক্ষ্ণ কূটনীতিক-এ পরিণত হতে থাকেন, ভালো লাগে একটি বিশেষ দৃশ্যে সাম্প্রতিক রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রসঙ্গ এনে ফেলা। তাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে যান বিষ কিনতে আসা ভদ্রলোক সুমন সিংহ রায়। জয়ন্ত দে চরিত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ঔদ্ধত্য, হতাশা, অসহায়তা অত্যন্ত সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলেন অভিনেতা সুমন। পার্থ গোস্বামী ও সুমন সিংহ রায়ের আশ্চর্য আন্ডার অ্যাক্টিং এ নাটকটি কোথাও উচ্চকিত হয়ে ওঠে না। নাটকের শেষ দৃশ্যে একটি ছোট চরিত্রে রাজা ঘরামীও যথাযথ দায়িত্ব পালন করে যান। নাটকটি পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত একবিংশ নাট্যমেলায় শিশির মঞ্চে দেখা হলেও, শুনেছি নাটকটি কোভিডোত্তর সময়ে ছোট ইন্টিমেট স্পেসের কথা মাথায় রেখে বানানো, সেক্ষেত্রে এ নাটক দর্শকদের আরও অন্তরঙ্গতায় ছুঁতে পারবে বলেই বিশ্বাস।
সোনারপুর উদ্দালক এর পক্ষ থেকে অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানাই অনুপমবাবুকে। আপনার সাথে সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকলাম. ধন্যবাদ জানাই অশোকনগর নাট্যমুখ কে।
অত্যন্ত জরুরি নাট্য। এ সময়ের।