নিজের প্রতিভাকে সদ্ব্যবহার করেছে মিঠু চক্রবর্তী | বিজয়কুমার দাস, পর্ব -৩১

এই প্রজন্মের বাংলা থিয়েটারে মেয়েদের মধ্যে যারা লড়াই করে ঘাম ঝরিয়ে পায়ের নিচে শক্ত মাটি তৈরি করে নিয়েছে তাদের মধ্যে মিঠু চক্রবর্তীও একজন। থিয়েটারের অঙ্গণে মিঠু কাজ করে চলেছে নানারকম চরিত্রে। খুব স্বল্প সময় অভিনয়ে সুযোগ পেলেও মিঠু সেই সময়ের মধ্যেই নিজের অভিনয় প্রতিভা উজাড় করে দিয়ে শিল্পীর জাত চিনিয়েছে। তাই নানা দলের বিভিন্ন নাটকে বিচিত্র সব চরিত্রে মিঠুর ডাক পড়ে। সব চরিত্রকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে মঞ্চে প্রজাপতির মত মেলে ধরতে পারে অভিনেত্রী মিঠু।
তার চাওয়াও খুব বেশি নয়। প্রধান চরিত্র, পার্শ্বচরিত্র, স্বল্প সময়ের চরিত্র সব রকমের চরিত্রেই মিঠু ঠিক নিজের কাজটুকু করে অভিনয়ের জন্য যেমন দর্শকের বাহবা আদায় করে নেয় তেমনি পরিচালকের কাছে অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মিঠুর ছোটবেলা কেটেছে হুগলির বৈদ্যবাটিতে। পরে চলে আসে ব্যারাকপুরে।ছোট থেকেই নাচ গানে একটা দক্ষতা ছিল।তখন পাড়ার ফাংশন মানেই মিঠুর নাচ গান থাকবেই। মা সান্ত্বনা চক্রবর্তী ও বাবা শ্যামাপদ চক্রবর্তী মিঠুর নাচ গানে খুবই উৎসাহ দিতেন। মিঠুও পাড়ার ফাংশনে নাচ গানে আমন্ত্রণ পেলেই এক ডাকে রাজী।
সেই মিঠু ১৯৯৯ সালে যখন নবম শ্রেণির ছাত্রী তখন ব্যারাকপুর সৌপ্তিক দলে প্রথম নাটক করে। দিলীপ করের পরিচালনায় “দেনাপাওনা” নাটকে ছায়া চরিত্রে প্রথম মঞ্চে নামা। তেমন কতজনই তো জীবনের প্রথমদিকে নাটক করে। কিন্তু পরে নাটকের সঙ্গে আর যোগাযোগই থাকে না। কিন্তু মিঠুর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। নাটকের প্রতি কোথায় যেন একটা ভালবাসা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তেমন সুযোগ ঘটছিল না। কলেজের ফেস্ট-এ নাটক করেছে। কিন্তু সেও তো অনেকেই করে।বিয়েও হয়ে গিয়েছিল। তারপর যথারীতি সংসারের পাশাপাশি নাটক করার সুযোগও এসে গেল। ২০০৫ এর পরে থিয়েটার করার সুযোগ এল দমদম শব্দমুগ্ধ নাট্যদলে। এরপর ইফটা নাট্যদলেও নাটক করার সুযোগ এসেছে মিঠুর।

বলা বাহুল্য, নিজের অভিনয় প্রতিভার গুণে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মিঠু। ভালো অভিনয় দিয়ে সে দর্শকের নজর কাড়ল। এবার আরো বড় সুযোগ পেল মিঠু থিয়েটারের অঙ্গণে। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির “মুক্তধারা” নাটকের কর্মশালাভিত্তিক (২০১১-১২) প্রযোজনায়। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। অম্বা চরিত্রে মিঠু নিজেকে মেলে ধরল তার অভিনয় প্রতিভার গুণে। এই দেবেশবাবুর সঙ্গেই শিশু কিশোর আকাদেমির “বীরেশ্বর” নাটকে যে দুজন সহকারী পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিল তাদের একজন কাজল শম্ভু এবং অন্যজন মিঠু চক্রবর্তী। মিঠু মনে করে, এই দায়িত্ব থিয়েটারের ক্ষেত্রে তার মনের জোর অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এরপর আর থিয়েটার ছেড়ে থাকার উপায় ছিল না মিঠুর। কারণ সুযোগ মিলেছিল মিনার্ভা রেপার্টারিতে। ২০১৪-১৮ মিনার্ভা রেপার্টারিতে নিজেকে থিয়েটারের জন্য গড়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সেই সময় মিনার্ভার প্রযোজনা দেবাশিস রায় পরিচালনায় “কাঁকড়া”, ব্রাত্য বসুর পরিচালনায় ” মুম্বাই নাইটস”, অরুণ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় “খড়ির গণ্ডি ” নাটকে অভিনয় করেছে মিঠু। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা মিলেও পাঁচের পাঁচালী, য্যায়সা কা ত্যায়সা, মৃচ্ছকটিক, তক্ষক প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেছে।

প্রসেনজিৎ বর্ধন, রাজীব বর্ধন, সুমন্ত রায় প্রমুখ নাট্যজনেরা এইসব নাটকের দায়িত্বে ছিলেন। সে সব স্মৃতি মিঠুর অভিনয় জীবনের সুখকর স্মৃতি।
২০১৮ সালে মিঠুর অভিনয় জীবনে এলো আর একটা অভাবনীয় সুযোগ। কৌশিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত সংশপ্তক দলের “ডানা” নাটকে অভিনয় করার কথা হলো। সেই সময় বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে অভিনয়ে দাপিয়ে বেড়ানো তুখোড় অভিনেতা প্রসেনজিৎ বর্ধনের বিপরীতে। তারপরেই বালাজী প্রোডাকশনের “মর্জিনা মর্জিনা” এবং ড: সিতাংশু খাটুয়ার পরিচালনায় “কালপুরুষ” নাটকে। সিতাংশু খাটুয়া পরিচালিত গড়িয়া কৃষ্টি প্রযোজিত কালপুরুষ ছাড়াও মাধুকরী এবং গর্ভধারিণী নাটকেও অভিনয় করেছে মিঠু।

তারপরেই করোনার আবহে থিয়েটারে নেমে এলো একটা সাময়িক সর্বনাশের কালো ছায়া। একের পর এক মঞ্চ বন্ধ। বন্ধ হয় গেল মঞ্চে অভিনয়ের সুযোগ। কিন্তু থেমে থাকেনি অভিনয়কে পেশা হিসাবে বেছে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়া অভিনেত্রী মিঠুর লড়াই। প্রসেনজিৎ বর্ধনের সঙ্গে “সারমেয় সংবাদ ” নাটক তখন প্রস্তুতির পথে। রাহুল দাসের ব্যবস্থাপনায় এরেঞ্জড ম্যারেজ, কাব্যকলা মনন এর নরক নন্দিনী ইত্যাদি ছোট নাটকে অভিনয় চলছিলই। কখনো ঘরে বসে বা স্টুডিও রেকর্ডিং, ভরসা তখন ঘরে বসে নাট্যচর্চা বা সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা। ২০১৯-২০ নাগাদ করোনার ঠিক আগে “বিবাহবিভ্রাট”নাটকে অভিনয়। সুদীপ সিনহার প্রযোজনায় ১২ টা ছোট নাটক রেকর্ডিং এর “ভালবাসা মুঠো” নাটকেও ছিল মিঠু। সরীসৃপ অডিও নাটকে তৃপ্তি মিত্র অভিনীত চরিত্রে অভিনয়। এ সবই করোনা অতিমারিতে প্রচেষ্টা। সে এক অন্য লড়াই।করোনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে থিয়েটার নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। আর সেই সময়েই প্রসেনজিৎ বর্ধন নামের দুরন্ত তুখোড় অভিনেতা জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে আচমকা বিদায়। থিয়েটারের জগতে ইন্দ্রপতনের মত।মিঠুর সঙ্গেও বিভিন্ন নাটকে প্রসেনজিৎ এর একটা অভিনয়ের রসায়ন গড়ে উঠেছিল।করোনার পরে “সারমেয় সংবাদ ” মঞ্চস্থ হলেও সেই নাটকে আর অভিনয় করেনি মিঠু, করতে পারেনি। প্রসেনজিৎ নেই।

মিঠুর অভিনয় জীবনে মাইলস্টোন অবশ্যই বারাসাত রমেশপল্লী ( সুদীপ সিনহা) প্রযোজিত “বিনয়ের জীবন ” কিংবা অভিনেতা সুমন্ত রায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে “দ্বিতীয় পক্ষ ” র মত নাটক। পিয়াল ভিট্টাচার্য পরিচালিত চন্দনগর সারঙ্গ দলের “নির্বাসিত নায়ক “, সোহম সরকার পরিচালিত যাদবপুর মন্থনের “ইলা”, ” শুন মনসা কথা ” এবং অশোকনগর প্রতিবিম্বর “ঠাম্মি” ,”অন্তর্বাস” ও শুভাশিস ভট্টাচার্য পরিচালিত রাজডাঙা দ্যোতকের “হনন” নাটকেও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছে মিঠু। কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর দেবনাথ, হরকুমার গুপ্ত প্রমুখের কর্মশালায় থিয়েটারের নানা বিষয়ের পাঠ নিয়েছে সে। অনিমেষ দেবরায়ের ওয়েস্ট বেঙ্গল নিফা দলে বিজয় ভট্টাচার্য রচিত “অনিকেত” এবং মনোজ মিত্র রচিত “পাখি” নাটকে নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছে মিঠু।

দেবগোপাল মণ্ডলের “নিষিদ্ধ ব্রতকথা” এবং “ছেলে কার” সহ কিছু চলচ্চিত্র এবং কালার্স বাংলার “প্রথম প্রতিশ্রুতি ” এবং “সাত পাকে বাঁধা” ইত্যাদি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছে।গৌতম ঘোষ পরিচালিত শূন্য অঙ্ক, আরণ্যক চ্যাটার্জীর অলৌকিক অভিযান, বিক্রমাদিত্য মোটেওয়ালের লুটেরা ( হিন্দি), রামকমল মুখার্জীর দ্য ব্রোকেন ফ্রেম (হিন্দি), শিলাদিত্য গুহর মনের চোরাবালি, মৈনাক ভৌমিকের একান্নবর্তী চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছে। তবু থিয়েটারই তার প্রথম প্রেম। কারণ লড়াই করে থিয়েটারের সাম্রাজ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে বলে মনে করে অভিনেত্রী মিঠু চক্রবর্তী। সেই লড়াই চলছে এবং চলবে।

14 thoughts on “নিজের প্রতিভাকে সদ্ব্যবহার করেছে মিঠু চক্রবর্তী | বিজয়কুমার দাস, পর্ব -৩১

  1. মিঠু কাজকে অনেক শ্রদ্ধা জানাই। আরো বেশি বেশি করে নতুন নতুন প্রযোজনা আমাদের উপহার দিন। ভালো থাকবেন।

  2. যে দেখতে নারী সে সর্ব গুণধারি♥️

  3. মিঠুর কথা লিখতে পেরে ভাল লেগেছে।দেবগোপাল মণ্ডলের ” নিষিদ্ধ ব্রতকথা” ছবির শ্যুটিং এ মিঠুকে প্রথম দেখি।আমিও ছিলাম ছবির একটা চরিত্রে।তারপর আবার একটা ছবির ফ্লোরে দেখা ডাবিং করতে এসে।ওর নাটক দেখেছি তার পরে।অবাক হয়েছি।সব রকমের চরিত্রে অনন্যা।মিঠু,চরৈবেতি।

    1. Thank you Bihoy da tumi je amk nobe rekhecho.. Tarpr amk niye eto sundar vabe likhecho.. Xmi porte porte amar struggle ta dekhte pachilam.. Anek ta dhonnobaad

  4. ভাল থাকিস। অনেক কাজ করিস। ভাল লাগল। বিজয় দা অসীম দাকে ধন্যবাদ এমন গুণী প্রতিশ্রুতিমান বন্ধুদের হাজির করছেন এখানে।

  5. মিঠু দি ❤️❤️❤️❤️❤️🙏🙏🙏🙏🙏

  6. মিঠু আমার একজন প্রিয় অভিনেত্রী। ‌ ভালো অভিনেত্রীর সাথে সাথে একজন ভালো মানুষও বটে-এই ভাবে এগিয়ে যাক নিজের কাজে, থিয়েটার জগতে ওর ডানা মেলে ধরুক এমন উজ্জ্বলভাবে— ওর জন্য আমার প্রাণ ভরা শুভাশিস আর আদর রইল।

Comments are closed.