সম্পাদক নির্দেশিত ‘নাট্যকার বনাম নির্দেশক’ বিষয়ে লিখতে বসে শুরুতে বলি, ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান এর মত করে নাট্যকার ও নির্দেশকের সমস্যা বা সম্পর্ক ভেবে বসলে গোলমাল হয়ে যাবে। ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় দুই প্রতিপক্ষের মত নাট্যকার ও নির্দেশকের ভূমিকা ক্রিয়াশীল নয়। যদিও এই দুটি বিভাগের কাজে দুই ব্যক্তির ইগো প্রায়শ মারাত্মক আকার নেয়।
নাট্যকারের সঙ্গে নাট্যপরিচালকের দ্বন্দ্ব বহুকালের। নাট্যকার আন্তন চেখভের সঙ্গে নাট্যনির্দেশক স্তানিশ্লাভস্কির বন্ধুত্ব নিবিড় ছিল। পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতামূলক মনভাব থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েকবার চেখভ বিরক্ত ও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে সরে গেছেন। সিগাল প্রযোজনা দেখবার পরে চেখভ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি আর কখনো স্তানিশ্লাভস্কিকে নাটক দেবেন না। কারণ চেখভের ভাবনা নাট্যচরিত্রের বিন্যাস স্তানিশ্লাভস্কির প্রযোজনায় ভিন্ন অর্থে রূপ নিচ্ছে। বার্ণাড শ কখনো তাঁর নাটকের প্রযোজনায় খুশি হতে পারেননি। তিনি সাধারণত তাঁর নাটকের অভিনয় দেখতে যেতেন না। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সঙ্গে শিশির ভাদুড়ির বিতর্ক ও বিরোধ সুবিদিত। শরৎচন্দ্র তাঁর নাটকের খাতা শিশির ভাদুড়ির সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বারান্দা পেরিয়ে চলে গেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন— ‘তুমি যা খুশি করো আমার নামটা রেখো না’।
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় নাট্যকার হবার বাসনায় সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন। সে এক তিক্ত করুণ অধ্যায় গেছে তাঁর জীবনে। পরের দিকে যখন তাঁর নাটক পাবলিক থিয়েটারে অভিনীত হয়েছে— তিনি অভিনয় বা প্রযোজনা দেখে খুশি হতে পারেননি।
শৌভিক সাংস্কৃতিক চক্রের গৌতম মুখার্জীকে নাট্যকাররা নাটক দিতে চান না। আমি ‘সাইকেল’ করবার অনুমতি দিলে বহুজন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সরাসরি বলেছেন, আপনাকে গৌতম গিলে খাবে। ওটা গৌতমের সাইকেল হয়ে যাবে। আপনার থাকবে না।
এসব হল দুই ব্যক্তিত্বের সমস্যা। আমার জীবনেও ঘটেছে। নাম না করে বলি- বেশ কয়েকজন নির্দেশক আমার নাটককে খুন করেছেন। আবার লেখা বুঝে না বুঝে হিট করিয়েছেন। সিনেমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এই রকম ঘটে। বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমা দেবী বলতেন, ‘ওটা তো সত্যজিতের পথের পাঁচালী, আমার স্বামীর নয়’। রবীন্দ্র পূজারীরা অন্ধ ভক্তের দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যজিতের রবীন্দ্র আশ্রিত ছবিগুলোকে গ্রহণ করতে পারেন নি। বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। পৃথিবীতে যে সকল নাট্যকাররা রঙ্গমঞ্চ থেকে দূরে বসে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বিশুদ্ধ নাট্য সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছেন, তাঁরা কখনো তাঁদের নাটকের মঞ্চরূপ দেখে খুশি হতে পারেন নি। কারণ মঞ্চে তাঁরা তাঁদের সাহিত্য কর্ম খুঁজে পান না। এক ধরনের ছেলেমানুষী মনভাব ও মঞ্চের ভাষা আয়ত্ত না থাকার জন্য সর্বপরি মঞ্চের পাটাতনে বিশুদ্ধ সাহিত্য যে অচল এই বোধ না জন্মানোতে যত বিতর্ক বিরোধের সৃষ্টি।
ঘোড়ার আস্তাবল থেকে শুরু করে রঙ্গমঞ্চের সিফ্টারের কাজ করতে করতে মহান নাট্যকার শেক্সপিয়রের জন্ম হয়। একটা সময় তাঁর হাতে পূর্বসুরী নাট্যকারদের মঞ্চে অসফল বহু নাটক এসেছিল। সেগুলো নতুন করে লিখে তিনি মঞ্চসাফল্য এনে দিয়েছিলেন। ব্রেখটের যুগান্তকারী নাটকগুলো উচ্চস্তরের নাট্য সাহিত্য
যে নয়, এটা বলার জন্য সাহসের দরকার হয় না। সাধারণ সাহিত্য জ্ঞান থাকলে বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলো উচ্চস্তরের নাট্যসাহিত্য। যোগ্য এবং সাহসী পরিচালকের অভাবে সে সব নাটক জনপ্রিয়তা পায়নি। একদিকে রবীন্দ্র ভক্তদের অন্ধত্ব অন্যদিকে বিশ্বভারতীর লালচোখ এতদিন বাধ্য হয়েছিল। শম্ভু মিত্র রবীন্দ্র প্রযোজনায় যে সাফল্য অর্জন করেছেন সেটা শেক্সপিয়রের সাফল্য ছুঁতে পারেনি। আপামর জনগণ শম্ভু মিত্রর রবীন্দ্র প্রযোজনায় স্বাদ পায় নি। সম্ভবত শম্ভুবাবু চাননি বা বুঝতেন ওটি ঘটলে তিনি ব্যর্থ হবেন।
থিয়েটার ও নাট্য সাহিত্য যে সম্পূর্ণভাবে দুটো আলাদা ব্যাপার এইটে ক’জন বোঝেন? ছোট বা একাংক নাটকের দলগুলোর নাট্যনির্দেশকদের অধিকাংশ এ ক্ষেত্রে বোধের সীমাবদ্ধতা বর্তমান। প্রথিত যশা এবং প্রবল ব্যক্তিত্বের নাট্যকারদের নাটক হাতে পেলে তারা আত্মসমর্পণ করে বসেন। সেই নাটকের জেরক্স কপি অভিনেতাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। অভিনেতারা দাড়ি কমা সহ মুখস্থ করে ফেলেন সংলাপ। মঞ্চরূপটাও হয় তখন কাঁচা নাটকের জেরক্স কপি। আমি বিচারক হয়ে নাট্য সমালোচনা করতে বসে বহু প্রযোজনায় পরিচালককে খুঁজে পাই না।
এদেশে সম্ভবত উৎপল দত্ত প্রথম ব্যক্তি যিনি সাহসের সঙ্গে নাট্যকারের ভূমিকা খর্ব করে থিয়েটারে পরিচালকের ভূমিকা বড় করে দেখেছেন। থিয়েটার যে সব সময় সর্ব অর্থে পরিচালকের থিয়েটার এই ঘোষণা করেছেন। তিনি বলতেন, শুরুতে দেশী বিদেশী ক্লাসিক নাটক নিয়ে নাড়াচারা করবার পরে তাঁকে নাটক লিখতে বাধ্য হতে হয়েছে। কারণ তিনি যা প্রযোজনা করতে চান তেমন নাটক পান নি বা পান না।
বিদেশে পেশাদার চিত্রনাট্যকার পাওয়া যায়। এদেশে পাওয়া যায় না বলেই- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনদের চিত্রনাট্য লিখতে বাধ্য হতে হয়। এমন কি সিনেমার আবহ সঙ্গীত রচনাতেও খবরদারি করতে হয়।
নাট্যকার কলম দিয়ে নাট্য সাহিত্য রচনা করেন। সিনেমার পরিচালক ক্যামেরা দিয়ে গল্প বলেন বা লেখেন। যা সেলুলয়েড লিটারেচার হয়ে ওঠে। নাট্য পরিচালক মঞ্চের ভাষায় গল্প বলেন। অভিনয়, আলো, দৃশ্যপট, সঙ্গীতের সমন্বয়ে তিনি প্রযোজনাটিকে সাজান। এখানে তাঁর ভূমিকা রাঁধুনির মত। রন্ধন শিল্পের তোয়াক্কা না করে পরিচালক অগ্রসর হতে পারেন না। নাটকের পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রী, আলো, মঞ্চসজ্জা, সঙ্গীত সবই কাঁচা মাল। কোন বস্তু কতটা অনুপাতে কোন বস্তুর সাথে মেশাবেন এই দক্ষতা নাট্যপরিচালকের থাকা দরকার, তিনি রসের কারবারি, দর্শককে তিনি যা পরিবেশন করেন তা রসময় এবং উপাদেয় হতে হবে। কত নাটক যে শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর হয়ে গেছে পরিচালকের এইসব গুণের অভাবে।
কথায় বলে কালি কলম মন, লেখে তিনজন। তাই নাট্যকার, পরিচালকের সমন্বয়ে থিয়েটার শিল্পের শরীর গঠন শুরু হয়। থিয়েটার হয়ে ওঠে তিলোত্তমা। যদিও আজকাল N.S.D-র তরুণ ছাত্ররা কালাপাহাড়ি তান্ডবে নাট্যকারের প্রয়োজন একেবারেই বাতিল করা শুরু করেছেন। থিয়েটারের নামে এক ধরনের সার্কাস প্রদর্শন।
নাট্যকার বনাম পরিচালকের বিতর্কে নাট্যসম্পাদনা বিভাগীয় দক্ষতাও বিজড়িত এবং এইখানে আর এক ছেলেমানুষী পরিচয় দেখা যায়। পরিচালক মশাই খুশি মত পাণ্ডুলিপি থেকে সংলাপ কেটে দিয়ে ভাবেন সম্পাদনার কাজটা হয়ে গেল। অনেক সময় বড়নাটককে কেটে ছোট ছোট নাটকে দাঁড় করান হয়। তিনি বোঝেন না যে এক ট্রাক ভর্তি জামা কাপড় ছোট একটা হাত বাক্সে ঢোকানো মানে তো হাত বাক্সটাকে ফাটিয়ে দেওয়া।
শেষ কথা এটাই নাটক আর থিয়েটার ভিন্ন শিল্প মাধ্যম। নাট্যকার কথাশিল্পের ধারায় নাট্য সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। তিনি যখন সেটা ছাপতে প্রেসে পাঠান তাকে মনে রাখতে হয় যে, পাঠক পড়বেন। তখন পাঠক একা, একক সত্তা দিয়ে পাঠ করে সাহিত্যের রস আহরণ করবেন। সেই নাটকটি যখন নাট্য পরিচালক গ্রহণ করেন, তখন তাকে ভাবতে হয় পাঠক নয় দর্শকের কথা। নিরক্ষর দর্শক, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সমস্ত স্তরের দর্শক রঙ্গমঞ্চের দর্শকাসনে বসে চোখ কান দিয়ে অভিনয় দেখবেন। নাটকের কোন ছাপা পৃষ্ঠা একই সময় বার বার পড়া যায়। দর্শক পারে না কোন অভিনীত দৃশ্যাংশ থামিয়ে দিয়ে বার বার দেখতে। ফলত পরিচালক পাণ্ডুলিপির কাগজ হাতে নিয়ে প্রথমেই নাটকটার প্রোডাকশান স্ক্রিপ্ট করতে বসবেন। শম্ভু মিত্র যাকে বলেছেন থিয়েটারের স্বরলিপি রচনা করা। এইটে তৈরি করতে বসে যদি দেখা যায় মূল পাণ্ডুলিপির অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে তাতে নাট্যকারের ক্ষোভ হলেও পরিচালকের কিচ্ছু যায় আসে না। প্রায়শই দেখা যায়, নাট্যকারের শৈলী, মেজাজ, এমনকি দর্শনও পরিচালকের স্বরলিপিতে থাকছে না। না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ দুই স্রষ্টার স্টাইল, দর্শনে ভিন্নতা থাকবেই। এখানে কেউ কারোর দাস নয়, অনুগত নয়। পরিপূরক হয়েও আলাদা সত্ত্বা। পরিচালক নতুন ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গীও আনতে পারেন। ভারতবর্ষে গোটা কুড়ি রকম রামায়ণ প্রচলিত। সবকটাই ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গীজাত। মাইকেলের ‘মেঘনাধ বধ কাব্য’ আর রবীন্দ্রনাথের রামায়ণী ভাবনাও তো এক নয়। গত চারশ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে কত সহস্রবার কত সহস্র ব্যাখ্যায় শেক্সপিয়র প্রযোজনা হয়েছে। মহাকবির অবদান তাতে খাটো হয় নি। ব্রেখটের নাটকও যদি কেউ তার বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের বাইরে গিয়ে পরিবেশন করতে পারেন- তাহলে পরিচালকের মুন্সীয়ানা চমকিত করবে। একই ভাবে নতুন দিনের নতুন পরিচালক রবীন্দ্রনাটকের নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে পারলে রবীন্দ্রনাথের মর্যাদাহানি হবে না।
আমার কয়েকটা নাটক বিখ্যাত মানুষদের ছোট গল্পের অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠেছে। সেই নাটক দেখে গল্পকাররা খুশি হতে পরেননি। অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অথচ আমার নাটকগুলো বিপুল জনপ্রিয়তার সঙ্গে বুদ্ধিজীবী মহলে সমাদৃত হয়েছে। আমিও জানি ওইসব অকিঞ্চিতকর গল্পর চেয়ে আমার প্রযোজনার মান অনেক সমৃদ্ধ। গল্পকারের সঙ্গে নাট্যকারের এহেন ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব থাকবেই।
মনে রাখতে হবে যিনি গীতিকার তিনি যেমন স্রষ্টা, সুরকার যেমন স্রষ্টা, গায়ক মানুষটিও বাণী ও সুরের মায়াজালে বন্দী হয়ে না থেকে গায়কির বৈশিষ্ট্যে তিনিও স্রষ্টা হতে চান। প্রতিভার স্পর্শে সৃষ্টির ধারা অনন্তে পৌঁছতে চায়। অতএব নাট্যকার বনাম নাট্যনির্দেশক নয়। থিয়েটার তিলোত্তমা শিল্প হয়ে ওঠে মিলিত সুরের ঐকতানে।
দারুণ ❤️
অসাধারণ ♥️
Esob anupreona jogay