এই নাটকটি দেখার অনুভব সম্পর্কে কিছু লেখার আগে নান্দীমুখর প্রাককথন বলে নেওয়া প্রয়োজন মনে হয়। ১৯৭৭ সালে ‘সাংগঠনিক কারণ’- এ নিজের তৈরি করা দল নান্দীকার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন শ্রদ্ধেয় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই বছরেই ৯ সেপ্টেম্বরে তিনি নান্দীমুখ গঠন করলেন। প্রথমদিকে নান্দীকারের পুরোনো নাটকগুলি যেমন- শের আফগান, তামাকু সেবনের উপকারিতা, নানা রঙের দিন ও প্রস্তাব ইত্যাদি নাটকগুলি মঞ্চস্থ করে। ১৯৭৮ সালে তলস্তয়ের জন্ম সার্ধশতবর্ষে ‘ পাওয়ার অফ ডার্কনেস ‘ অবলম্বনে ‘পাপপুণ্য ‘ নাটকটি মঞ্চে উপস্থাপিত হয়। তারপর হ্যারল্ড পিন্টারের ‘ বার্থ ডে পার্টি’ অবলম্বনে অজিতেশবাবু মঞ্চস্থ করলেন ‘ ৩৩ তম জন্মদিন’। নান্দীমুখের গোড়ার ইতিহাসে এই দুটি ছিল মঞ্চসফল প্রযোজনা। তারপর সময়ের জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে।
সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা ‘ লন্ঠন সাহেবের বাংলো’ মধুসূদন মঞ্চে দেখে এলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা এই গল্পটি আগেই পড়া ছিল। এই গল্পের মধ্যে ইতিহাসের ছায়া যদি খোঁজা যায় দেখা যাবে -উত্তর ২৪ পরগণায় ১৯০০ সালে গোসাবা ও রাঙাবেলিয়া অঞ্চলে এক স্কটিশ হ্যামিল্টন সাহেব জমিদারি কেনেন। তিনি নদীনালা জঙ্গুলে এলাকায় ম্যানগ্রোভ সাফ করে বাদা অঞ্চলে সমবায় প্রথায় ধানচাষ, ইস্কুল স্থাপন, হাট বসানো, তাঁত শিল্পের উন্নতি ইত্যাদি প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করেন। তাঁর গ্রামীণ উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে দেখে গেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী হ্যামিল্টন সাহেবের গ্রামীণ উদ্যোগকে স্বচক্ষে দেখার জন্য তার প্রধান আপ্তসহায়ককে পাঠিয়েছিলেন। এখনো সুন্দরবনে হ্যামিল্টন সাহেবের নামে দ্বীপ, হাট- বাজার আছে। এটা হলো ইতিহাসের অধ্যায়।
এবার আসি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে এবং বর্তমান সময়প্রবাহে ‘ লন্ঠন সাহেবের বাংলো’কে নাটক মঞ্চস্থ করার অনিবার্যতা আমার চোখে কিভাবে ধরা পড়েছে। মূল গল্প আর নাট্যরূপে কিছুটা ফারাক আছে। লেখা একমাত্রিক কল্পনায় তা বহুমাত্রিক রূপ নেয় কিন্তু মঞ্চে থ্রী ডাইমেনশনে উপস্থাপিত করতে হয়। নাট্যসূত্র ধরিয়ে দিলে আলোচনা পাঠে সুবিধা হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা চার্লস হ্যামিল্টন সাহেব ইব্রাহিমপুর গ্রামে চাকরিসূত্রে আসেন। তিনি আর তার স্ত্রী জেনি সেই গ্রামের মানুষকে ক্রমশঃ ভালবেসে ফেলেন। তার স্ত্রী জেনি নানান গাছের বাগানে বাংলোটাকে সাজিয়ে তোলেন। সাহেব নিজের জমানো টাকা দিয়ে হাট- বাজার বসান এবং মানুষের বিপদে- আপদে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। সাধারণ মানুষ ‘ হ্যামিল্টন ‘ উচ্চারণ করতে পারত না তারা বলতেন ‘ লন্ঠন সাহেব’ ইতিমধ্যে জেনি মারা যান এবং বাংলোর বাগানেই জেনিকে কবর দেওয়া হয়। সাহেব জেনি- র স্মৃতিচারণায় ক্রমশঃ মদ্যপানে ডুবে যেতে থাকেন।অবচেতনস্তরে প্রতি রাতে সাহেব মাতাল হয়ে কবরের কাছে গিয়ে জেনির সাথে কাল্পনিক একাকি কথা বলতেন এবং জেনির সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। সাহেবের কাছে বাংলোতে ফটিক, কাসেম ও লক্ষী এই পরিচারক- পরিচারিকারা দীর্ঘদিন ধরে সাহেবের দেখভাল করে আসছে। ফটিক ও কাসেম ছোটবেলা থেকেই সাহেবের আশ্রিত ছিল। এই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার মহারাণীর উপর ন্যস্ত হলে কোম্পানি স্থানীয় জমিদারদের কাছে জমিদারি বিক্রি করে মুনাফা গুটিয়ে আনতে শুরু করেছিল। হ্যামিল্টন সাহেবকে কোম্পানি পেনশন দিয়ে বাংলো ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে যেতে অনুরোধ করল এবং ইব্রাহিমপুরের জমিদারিও কোম্পানি দেশিয় জমিদারকে বিক্রি করে দিয়েছিল। কোম্পানির প্রতিনিধির হুমকি থেকে জমিদারির লেঠেল বাহিনী অনেকবার চেষ্টা করল সাহেবকে বাংলোচ্যূত করতে কিন্তু স্থানীয় মানুষকে নিয়ে সাহেব প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সাহেবকে বাংলোচ্যূত করার জন্য কোম্পানি জেনির কবর নিয়ে কলকাতায় মর্য্যাদার সাথে সমাহিত করার এবং সাহেবকে কলকাতায় বাড়ি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন কিন্তু সাহেব এই মানুষজন,এই পরিবেশ ও জেনির স্মৃতি ছেড়ে যেতে চান না। হঠাৎ একদিন রব ওঠে। জমিদার স্বয়ং সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছেন। জমিদার দ্বারকানাথ ঠাকুর সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রস্তাব দেন তিনি এই বাংলোতে আজীবন থাকতে পারবেন এবং তাকে কেউ বাংলোছাড়া করবে না। হ্যামিল্টন সাহেব বিনামূল্যে বাংলো নিতে রাজি হননি। বিনিময়ে তিনি তার প্রতিষ্ঠিত নদীঘাটের কাছে বাজারটি জমিদারবাবুকে দিতে চান। সাহেব জমিদার প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছে একটি সাহায্য প্রার্থনা করেন – ইব্রাহিমপুর অঞ্চলের অনেক মানুষে চোখের অসুখে অকালে অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন। তিনি যদি এই অঞ্চলে একটি চক্ষু হাসপাতাল গড়ে দেন তবে খুব উপকার হয়। জমিদারবাবু সাহেবকে কথা দেন যে ইব্রাহিমপুরে তিনি চোখের হাসপাতাল করবেন।
তার পরের কাহিনী আরো অদ্ভুত। সাহেবের যখন মৃত্যু হয় তখন দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেতে। বড় বড় সাহেবেদের সাথে বিভিন্ন পার্টিতে মশগুল। ইব্রাহিমপুরে কোনো চক্ষু হাসপাতাল হয়নি কিন্তু ইংল্যাণ্ডে চক্ষু হাসপাতালের জন্য দ্বারকানাথ ঠাকুর দশ সহস্র মুদ্রা মহারাণীর তহবিলে দান করেন। নাটকটির মূল অপরিহার্যতা এখানে যে পুঁজি মুনাফার পিছনে দৌঁড়ায়। পুঁজির লগ্নি সেখানেই যেখানে শাসকের প্রশ্রয় থাকে কিন্তু পুঁজির উৎস যে জমি- মাটি- জল- জঙ্গল – মানুষের উপর জমিদারির স্বত্ত্ব এবং যে কর আদায়েই পুঁজির পুষ্টি – সেটাই ক্রমশঃ অবহেলিত হতে থাকে।
নাটকের চরিত্রের প্যারাডক্স বিদেশি মানুষ এ দেশের জল- মাটি – মানুষকে ভালবেসে ফেলেছিল কারণ হ্যামিল্টন ছিল নাবিক। তার ভালবাসার মানুষ যখন এই মাটিকে আশ্রয় করে তখন তার স্বত্ত্বার প্রকাশ সর্বত্র অনুভব করে। সামন্ততন্ত্র থেকে শিল্পপতি এই ক্রমপরিণতিতে দেশিয় ভূঁইফোড় জমিদারদের কাছে এর মূল্য নেই। এখানেই এই নাটকটির সার্থকতা আমার মনে হয়েছে।
এবার আসি নাটকের অভিনয় সম্পর্কিত আলোচনায়। নাটকের কেন্দ্রীয় ও সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি চরিত্র হ্যামিল্টন সাহেব। এই চরিত্রে বাংলা নাটকের মহীরূহ অসিত বসু। তার দীর্ঘ নাট্যজীবনের পরিক্রমায় উৎপল দত্ত থেকে আজকের নান্দীমুখ – অজস্র শিরোপা। অসিতবাবু হ্যামিল্টনের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন এবং ওঁনার অভিনয় উচ্চতার উপরেই নির্ভর করে আছে নাটকের ফ্রেম। দুটি শেড আছে – একটি সাহেবের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং অপরটি পরাবাস্তবতায় জেনির সাথে প্রেম। তবে এখানে গল্পকার আর নাট্যকারের মধ্যে চরিত্রের ব্যাখ্যার একটি সামান্য সূক্ষ্য প্রভেদ আছে। সুনীলবাবু লিখেছিলেন হ্যামিল্টন সাহেবের দেশীয় মানুষকে নিজের পক্ষে টানার জন্য কিছু বিচিত্র জনমুখী ও জনচিত্তমোহিনী কাজ করতেন। নাটকে চরিত্রের এই মোচড় অনুপস্থিত। ফটিকের চরিত্রে অমিত গাঙ্গুলির প্রথমে একটু জড়তা ছিল। কাসেম ও লক্ষ্মী চরিত্রে অভিনয় যথাযথ। নায়েব চরিত্রে দেবদাস চট্টোপাধ্যায় যতক্ষণ মঞ্চে ছিলেন নাটকে দ্বন্ধটা খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। জেনি চরিত্রে সোনালি চট্টোপাধ্যায় যথার্থ সংগত করেছেন। এই নাটকের স্বপ্নদৃশ্যগুলি অনবদ্য এবং তার সাথে সিম্ফনি-র প্রয়োগ মানানসই। নাটকে অসিত বসুর অভিনয়ের ডালপালা ছড়ানোর আশ্রয়ী চরিত্র জেনি, কাসেম, লক্ষী। এই চরিত্রগুলির মাত্রাযুক্ত অভিনয়েই লণ্ঠন সাহেবের চরিত্র সার্থকতা। বিপ্রতীপে ডেভিডরুপী চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, নায়েবরুপী দেবদাস চট্টোপাধ্যায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের অভিনয়ের দ্বান্ধিকরুপের উৎকর্ষতায় নাটকের আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের উপস্থিতি আরো একটু দর্শক চমকিত করার ভাবনা থাকলে ভাল হয় আর গল্পের শেষ রেশটা পরিচালকের মাধ্যমে বিবৃত হওয়ায় একদম নাটকের আবেশতায় একটি দ্রুত ছেদ পড়ে – যেটা আমার কাছে আকাঙখিত নয়। এই ফেড আউট আরো সুন্দরভাবে করা যেত। মঞ্চসজ্জা অনবদ্য। পিছনে বড় বড় গাছপালার সিল্যুট, একপাশে বাংলোতে ঢোকার গেট, বাংলোতে ঢোকার মুখে কবর এবং তার পাশে ইজিচেয়ার তবে লন্ঠন – একটি সিম্বলিক শব্দ। যে পথ দেখায়। সেখানে লন্ঠনটি বড়ই অনুজ্জ্বল এবং পজিশনে বেমানান। চোখেই পড়ে না। চরিত্রের ভাষা ২৪ পরগণা গ্রামীণ এবং ভদ্রজন ভাষার মিশ্রণ। পরিশেষে এই নাটকের পরিচালক অশোক চট্টোপাধ্যায় ও নাট্যকার সৌনাভ বসুকে ধন্যবাদ জানাই একটি ভাল নাটক উপহার দেওয়ার জন্য।
চমৎকার লেখা।
দুরন্ত রিভিউ।