দীপা ব্রহ্ম
শোনা যায় না বাঁশ খেলার গান
লুপ্ত হইতেছে দোতারা কুশান,
গোরক্ষনাথ আর বিষহরি পালা
যাইটল পূজা, সুবচনি, চোরচুন্নী গান
আর মেছনী
চার যুগের গান শোনা যায় না আর।
কোচবিহার জেলার ভোটবাড়ি গ্রামের কোনো অখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী গান গোটা উত্তরবঙ্গের লোক-আধারটিকে যেভাবে চিহ্নিত করেছেন তা শহুরে হৃদয়ের অন্তস্থলকে ভেদ করে এক অমোঘ পরিণতির ইঙ্গিতের আগাম চেতাবনি দিল। আজ বড়ো জরুরি মাটির লেপন ভেদ করে এই কাঠামোটি ছোঁয়ার। প্রজন্মের মানুষ হিসাবে এ আমার দায়। আমি মাথা পেতে নিলাম। পথে আগুয়ান হলাম তার পিছন পানে চেয়ে। আমার কলমের ধৈর্য দিয়ে আজ লিখছি উত্তরবঙ্গের অন্যতম একটি লোকনাটক ‘কুশানে’। এ সম্পর্কে জানতে ও জানাতে বললেন, কোচবিহার রেপার্টরি থিয়েটারের অক্ষয় ধর। জানালেন কুশানের মানে। ‘কু’ অর্থাৎ খারাপ ও ‘শান’ অর্থাৎ মার্জিত করে লোকশিক্ষামূলক প্রচার। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের মধ্যে এ পালা প্রচলিত।
কুশানে রামায়ণকে ঘিরেই। এ নিয়ে নানা মত আছে। কারো মতে ‘কুশীলব’ থেকে কুশানের সৃষ্টি। কারো ধারণা রামায়ণের প্রথম প্রচারক লব ও কুশ। কুশানে পালার নামকরণের সঙ্গে এভাবেই লব ও কুশের নাম জড়িয়ে রয়েছে। একটি তারযন্ত্র কুশানে পালায় ব্যবহৃত হয়। আন্তরিকভাবে একে ‘বেণা’ বলা হয়। সেই অর্থে এই পালাকে বেণা কুশানেও বলা হয়। ‘বেণা’ কুশানে পালার একটি অতি প্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক যন্ত্র। সাধারণত আশ্বিন থেকে শুরু করে বৈশাখ পর্যন্ত এই পালা অভিনয়ের সময়কাল। তবে এখন যে কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে কুশানে অনুষ্ঠিত হয়।
বলা যায় বিভিন্ন লোক পরিবেশনের মতো এ পালায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ কিছু বলা হলেও বেশিরভাগ সময়েই আদিভাবেই এ পালা-অনুষ্ঠান হয়। প্রথমে সমস্ত কুশীলবরা মিলে যৌথভাবে বাদ্য বাজান। এরপর পালায় বিভিন্ন দেবদেবীকে প্রণাম জানিয়ে পালাবন্দনা শুরু হয়। মূলত রামায়ণের চরিত্রের উদ্দেশ্য করে পালাবন্ধন এই কুশানের একটি বৈশিষ্ট্য। এরপরে খুব দ্রুত ছন্দে বাজনা বাজানো হয়। গীদল (গীতাল), অর্থাৎ মূল গায়েন দর্শককে প্রণাম জানিয়ে পালার নাম ঘোষণা করেন। গানের মধ্যে দিয়েই গীদল পালার ঘটনা এগিয়ে নিয়ে যান। পিছনে ধুয়া ধরেন দোহারিরা। কখনও তারা মজা-মশকরায় আসর মাতান। এভাবে মূল পালায় প্রবেশের পর শুরু হয় সংলাপ। ওদিকে চ্যাংড়া বা ছুকরীরা নাচ করতে থাকে। গীদল-দোয়ারি মিলে পালায় অভিনয় করে। আগে পালার সময় সীমা থাকতো না। এখন তিন থেকে চার, কখনো ঘণ্টাখানেকের মধ্যেও পালা শেষ হয়। মহিম গীদল, বিনয় বর্মন এ অঞ্চলে কুশানে শিল্পী হিসাবে পরিচিত। এই পালার অন্যতম বায়েন নীরদচন্দ্র রায় জানালেন, এ পালা এখন মঞ্চেও অভিনীত হয়। প্রায় ৪৫ বছর তিনি কুশানের সঙ্গে যুক্ত।
প্রয়াত কুশানে শিল্পী লোলিত কুশানের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। নীরদচন্দ্র বাজনা শিখেছেন ধীরেন ক্ষ্যাপার কাছ থেকে। পরে তাঁর গুরু ছিলেন ন্যাপলা বর্মন। নতুন প্রজন্মকে কুশানে পালায় সংযুক্তির ব্যাপারে তিনি খুবই আশাবাদী। এখন মা বীণাপাণি কুশানে নাট্যসংস্থার সঙ্গে যুক্ত। লোলিত কুশানে (বর্মন) এর সঙ্গে বহু সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। এখন লোকশিল্পী ভাতার আওতায়ও আছেন। নীরদচন্দ্র মূলত একজন মৃদঙ্গ বাদক। বছরে ৫০ থেকে ৬০টি পালা তাঁরা করে থাকেন। লোলিত কুশানের আসল নাম লোলিত বর্মন। বাসা ছিলো দিনহাটার ফুলবাড়ি গ্রামে। ২০০০ সালের কিছু আগে থেকেই লোলিত বর্মন এ পালায় পরিবর্তনের আঁচ পেয়েছিলেন। কুশানেকে যাত্রার সঙ্গে যুক্ত করার প্রবণতা তাঁকে ভাবিত করেছিল।
বলা যায়, ওই সময় থেকেই মেয়েরাও এ পালায় অভিনয় করতে শুরু করে। লোলিত কুশানের নাম উত্তরবঙ্গের লোক-নির্যাসে বিশেষ নাম-মাহাত্ম্যের দাবি রাখে। কুশানে এমনই একটি লোকনাটক যার মাধ্যমে জগৎবীক্ষণ করা হয়। কুশানের আসরটিকে ৭টি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম স্তরে থাকেন গীদলরা। এটিকে গীদলঘর বলা হয়। যাবতীয় বাদ্যযন্ত্রও থাকে এই ঘরে। বলা যায় ভূত্বকের কেন্দ্রমণ্ডল নামের স্তরটি যেমন পৃথিবীর নানা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উৎস তেমনি গীদল ঘর। এখান থেকেই বাজনার মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে শুরু হয় কুশানে পালার নানা ঘাত প্রতিঘাত। দ্বিতীয় স্তর শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনের স্তর। তৃতীয় স্তরে বসেন দর্শক। সবটাই গীদল ঘরকে কেন্দ্র করে, বৃত্তাকার। বৃত্তের পরিধি বাড়তে থাকে। চতুৰ্থতে, মানুষের বাঁড়ি ঘরের অবস্থান কল্পনা করা হয়। পঞ্চমে বাজার, দোকান। ষষ্ঠে বাগিচা, মাঠ ও সপ্তমে মহাশূন্য বা মহাবিশ্বকে কল্পনা করা হয়। ভাবতে অবাক লাগে কীভাবে সৃষ্টি ও লয়ের কার্যকারণকে এই কুশানে শিল্পীরা তাঁদের লোক বাঞ্ছনাটিতে সম্পৃক্ত করেছেন। জাতীয় কাব্যগ্রন্থের যে চিরন্তন আবেদন তার সঙ্গে সৃষ্টির স্ফুরণকে সংযুক্ত করে নতুন ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন তারা, যা অন্য কোনো লোক প্রক্ষেপণে প্রকট নয়।
রামায়ণ যেভাবে সমাজজীবনে মনুষ্যকূলের জীবনবৃত্তের চিত্র নানা দৃষ্টিকোণ থেকে অঙ্কণ করে, এই তথাকথিত শংসাপত্রহীন মাটির নিকটের মানুষগুলি কেবল মনের টানে তাঁদের কোন উপলব্ধির প্রকাশ ঘটান তা ভাবনার অতীত। কুশানের আসরের মাধ্যমে আমরা শিক্ষিত হই। অর্থ, কাগজে দেগে দেওয়া সম্মান, অহংবোধ সবটাই এই মানুষগুলির কাছে ফিকে হয়ে যায়। মহাব্যোমের মতোই এই শূন্যতা আমাদের শুধু আপেক্ষিকতার আবর্তে ঘোরায়, মুগ্ধ করে ওই মানুষগুলির চিন্তার হরেক স্তরের অবতারণাকে। এই শেকড় সন্ধান আজও জারি। আজও মাতৃভূণের প্রাণ সম্ভারের দিনক্ষণ অনির্দিষ্ট, রহস্যের প্রহেলিকায় আবৃত। কোন মহাশূন্যে, কোন পৃথিবী গ্রহের কোন মহাদেশের কোন দেশের, কোন রাজ্যের একটি স্থানকে চাক্ষুষ করে, ভাবনার উৎস্রোতের তারিফ জানায়? অলেখ ইতিহাস থেকে কোথায় যে নিয়ে যায়, কে জানে?
দীপাদির লেখা সিরিজটা পড়ছি আর অবাক হচ্ছি যে বাংলাদেশে এত লোকআঙ্গিক রয়েছে, এত তার বিন্যাস। প্রায় সবটাই গ্টাম বাংলার প্রকৃত আনন্দ আহ্লাদের, জীবনজিবীকার আদর্শ চিত্র।
অপেক্ষায় রইলাম আগামীতে কোন বিষয় নিয়ে লিখবেন।
সত্যি বিস্ময়াবিষ্ট হতে হয় অভিনয়ের সঙ্গে দীপা ব্রক্ষ্মের এইসব কর্মকান্ডে।
অন্তরের কৃতজ্ঞতা, দীপাদি এবং “অমল আলো”-র প্রতি। এক অনন্য দলিল হয়ে উঠছে এই লেখা, এই পত্রিকা। এই লেখাগুলি সংকলিত করে কি একখানি বই হতে পারে ভবিষ্যতে? হলে বড় উপকার হয়। যদি হয়, আমরা গ্রাহক হিসেবে এখনই নাম লিখিয়ে রাখলাম।
👍🏼