নাটক | ক্ষীরের পুতুল | অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর | অভি চক্রবর্তী

মঞ্চ গোলাকার। চারিদিকে ছবিলেখক অবন ঠাকুরের নানান রাজা-রাজরার ছবি। ছবিগুলোকে কীভাবে বিন্যাস করবেন তার দায়িত্ব স্বয়ং নির্দেশকের। একটি কোরাস দল নাট্য শুরু করবে। তারাই চরিত্র হয়ে উঠবে আবার মিশে যাবে কোরাসে তথা জনতায়। সংগীত ও বাদ্য লাইভে হলেই ভাল।

জনতা- রাজার গল্প বলছি শোনো
নয় নতুন একেবারে।
সুয়ো দুয়ো দুই রানি
ছিল এক রাজার ঘরে।

আহা ছিল রাজার ঘরে (২)

দুই রানির, দুই মহল
রাজার ইচ্ছেমতো
সুয়ো থাকে সাত মহলে
দুয়ো দাসীর মতো

আহা দুয়ো দাসীর মতো (২)

সুয়ো রানির সেবা করেন
সাতশো দাস দাসী।
দুয়োর ঘরে শুধুই আঁধার
কান্না বাজায় বাঁশি

আহা কান্না বাজায় বাঁশি।( ২)

রাজসভা তৈরি হয়। নির্দেশক সামান্য বদলে এই সভার ছবি তৈরি করবেন। রাজা সহ পারিষদদের দ্যাখা যায়।

রাজা – মহামন্ত্রী, বেড়াতে যাব দেশ বিদেশে
জাহাজ সাজাও দ্রুত
সঙ্গে যাবে তুমি আর
সৈন্য শত শত।

মহামন্ত্রী – মহারাজ, আদেশ অনুযায়ী হবে কাজ
সাজাও সবাই স্বর্ণ জাহাজ।

সূত্রধর- আদেশ মতোই মহামন্ত্রী লেগে গেলেন কাজে।
সাজায় জাহাজ মহাযত্নে নানান কারুকাজে।

জাহাজ সাজানোর প্রক্রিয়ায় নাট্য প্রবেশ করে, রাজসভা থেকে সরাসরি।

জনতা- সেদিন একদিন
রাজা জানায়
রোদ ঝলমল সভা
বেড়াতে যাবেন
মাস ছয়েক
দেশের মহারাজা
মন্ত্রী জাহাজ সাজায়…
সাজে জাহাজ
রং-বেরং এ
বিপুল সমারোহ
রাজ্যজোড়া ব্যস্ততা
বাড়ছে অহরহ

রাজা সব পরখ করেন
পরখ করেন চেয়ে থাকেন
মহানন্দে দুলছে জাহাজ
নতুন করে নিজের‌ই ছন্দে

রাজ্যে সাজ সাজরব (২)

এই সাজসাজ রবের মাঝেই নাটক প্রবেশ করে ছোটরাণীর অন্দরমহলে।

(অন্তঃপুরে সোনার পালঙ্কে শুয়েছিলেন তিনি, সাত সখি সেবা করছিল তার, রাজা সেখানে গেলেন। সোনার পালঙ্কে মাথার শিয়রে বসে আদরের ছোটরাণীকে বললেন)

রাজা- রাণী, দেশ-বিদেশে বেড়াতে যাব, তোমার জন্য কি বলো আনব?

রাণী- মহারাজ আমার এই আসমানী মেঘের মতো সাদা হাত, হীরের মতো উজ্জ্বল যার ছটা তা যেনো বড়ো সাদা দেখায়। রক্তের মতো রাঙা আট -আটগাছা চুড়ি চাই আমার।

রাজা – আচ্ছা রাণী, মানিকের দেশ থেকে মানিকের চুড়ি আনবো। বলো আর কিছু কি চাই?

রাণী- (পা নাচিয়ে নাচিয়ে, পায়ের নুপুর বাজিয়ে বাজিয়ে বলেন) এ নুপুর ভালো বাজে না। আগুনের বরণ নিরেট সোনার দশগাছা মল পাই তো পরি।

রাজা – সোনার দেশ থেকে তোমার পায়ের সোনার মল আনব। আরো আরো কিছু চাও তো বলো রাণী?

(রাণী গলার গজমতি হার দেখিয়ে বললেন)

রাণী- দেখো রাজা এ মুক্ত বড়ো ছোটো, শুনেছি কোন সাতসাগরের তেরো নদীর পারের দেশে পায়রার ডিমের মতো মুক্ত আছে, তারই এক ছড়া হার এনো।

রাজা- সাগরের মাঝে আছে মুক্তোর রাজ্য, সেখান থেকে তোমার গলার হার আনবো। আর কি আনবো বলো?

(তখন আদরিনী সুয়েরাণী সোনার অঙ্গে সোনার আঁচল টেনে বললেন)

রাণী- মা গো, শাড়ি নয়তো বোঝা। আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি পাই তো পরে বাঁচি। এ অঙ্গে হালকা হয়।

রাজা – আহা, আহা তাই তো রাণী, সোনার আঁচড়ে সোনার অঙ্গে ছর লেগেছে, ননীর দেহে ব্যাথা বেজেছে। রাণী, হাসি মুখে বিদায় দাও, আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি আনিগো।

বিদায় দিলেন মহারাজকে
আদরের ছোটরাণী
দুঃখ ভরা কাঁথায় শুয়ে
দিন কাটায় দুয়োরাণী

এ ঘরে আজ কেউ আসেনা
কান্না বসত করে
যাবার আগে রাজা গেলেন
বড় রাণীর তরে।

রাজা- বড়োরাণী , আমি বিদেশ যাবো। ছোটরাণীর জন্য হাতের বালা, গলার মালা,পায়ের মল, পরনের শাড়ি আনব। তোমার জন্য কি আনব? বল যদি কিছু সাধ থাকে।

রাণী- মহারাজ, ভালোয় ভালোয় তুমি ঘরে এলেই আমার সকল সাধ পূর্ণ হয়। তুমি যখন আমার ছিলে তখন আমার সোহাগও অনেক ছিল, সাধও অনেক ছিল। সোনার শাড়ি অঙ্গে পরে সাতমহল বাড়িতে হাজার হাজার আলো জ্বালিয়ে সাতশো সখীর মাঝে রাণী হয়ে বসবার সাধ ছিল, সোনার পিঞ্জরে শুকশারীর পায়ে সোনার নুপুর পরিয়ে দেবার সাধ ছিল। মহারাজ, অনেক সাধ ছিল, অনেক সাধ মিটেছে। এখন আর সোনার গহনায় সোনার শাড়িতে কী কাজ? মহারাজ, আমি কার সোহাগে হারের বালা হাতে পরব? মোতির মালা গলায় দেবো? মানিকের সিঁথি গলায় বাঁধব? মহারাজ, সে দিন কি আর আছে! তুমি সোনার গহনা দেবে, সে সোহাগ তো ফিরে দেবে না! আমার সে সাতশো দাসী সাতমহল বাড়ি তো ফিরে দেবে না! বনের পাখি এনে দেবে, কিন্তু মহারাজ, সোনার খাঁচা তো দেবে না। ভাঙা ঘরে সোনার গহনা চোর-ডাকাতে লুটে নেবে, ভাঙা খাঁচায় বনের পাখি কেন ধরা দেবে? মহারাজ, তুমি যাও, যাকে সোহাগ দিয়েছ তার সাধ মেটাও গে, ছাই সাধে আমার কাজ নেই।

রাজা – না রাণী। তা হবে না, লোকে শুনলে নিন্দে করবে। প্রজাদের কাছে আমি অনেক নীচু হয়ে যাব। বল তোমার কি সাধ?

রাণী – কোন লাজে গহনার কথা মুখে আনব? মহারাজ, আমার জন্য পোড়ামুখ একটা বাঁদর এনো।

রাজা – বাঁদর? এই তোমার পছন্দ?
রাণী- হ্যাঁ রাজা। ঐ পোড়ামুখ বাঁদরের দিকে তাকিয়েই আমি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।

রাজা- আচ্ছা রাণী। তাই হবে। বিদায় দাও।

তখন বড়োরাণী – দুয়োরাণী ছেঁড়া কাঁথায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে রাজাকে বিদায় দিলেন।

সূত্রধর- রাজা গিয়ে জাহাজে চড়লেন। সন্ধ্যাবেলা সোনার জাহাজ সোনার পাল মেলে অগাধ সাগরের নীলজল কেটে সোনার মেঘের মতো পশ্চিমমুখে ভেসে গেল। ভাঙাঘরে দুয়োরানি নীল সাগরের পারে চেয়ে, ছেঁড়া কাঁথায় পড়ে রইলেন। আর আদরিণী সুয়োরাণী সাতমহল অন্তঃপুরে, সাতশো সখির মাঝে, গহনার কথা ভাবতে ভাবতে, সোনার পিঞ্জরে সোনার পাখির গান শুনতে শুনতে সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাজাও জাহাজে চড়ে দুঃখিনী বড়োরাণীকে ভুলে গেলেন। বিদায়ের দিনে ছোটোরাণীর সেই হাসি হাসি মুখ মনে পড়ে আর ভাবেন –

এখন রাণী কী করছেন? বোধহয় চুল বাঁধছেন। এবার রাণী কি করছেন? বুঝি রাঙা পায়ে আলতা পরছেন। এবার রাণী সাতমালঞ্চে ফুল তুলছেন, এবার বুঝি সাতমালঞ্চের সাতসাজি ফুলে রাণী মালা গাঁথছেন আর আমার কথা ভাবছেন। ভাবতে ভাবতে বুঝি দুই চক্ষে জল এল, মালা আর গাঁথা হল না। সোনার সুতো, ফুলের সাজি পায়ের কাছে পড়ে রইল, বসে বসে সারারাত কেটে গেল, রানির চোখে ঘুম এল না। (এগুলো রাজা ভাববেন, ছোটরাণী অভিনয় করে দ্যাখাবেন)

সুয়োরাণী – ছোটোরাণী রাজার আদরিনী, রাজা তারই কথা ভাবেন। আর বড়রাণী রাজার জন্যে পাগল, তাঁর কথা একবার মনেও পড়ে না।
(বড়রাণীকে ছেঁড়া কাথায় শুয়ে থাকতে দ্যাখা যায়)

গানের দল-

এমনি করে একটি বছর
জলে জাহাজে যায়
রাজার জাহাজ
তীরে ভেরে
মানিক-দেশের ঠায়।

সেথায় মানিক ভরা…

সেথায় মানিক ভরা সর্বখানে
এমনকি ঘাটের শানে
পথের কাঁকড়েও মিশল মানিক
আনন্দে নাচে গানে

রাজা গয়না গড়ায়
স্যাকরারা সব ব্যস্ত ভীষণ এখন
ছোট রাণী পরবে চুরি
মহোল্লাসে তখন

আবার গানের দল প্রবেশ করে-

গানের দল- চুড়ি নিয়ে, মহানন্দে
স্বর্ণদেশের পথে
ভেসে চল্লো জাহাজ আবার
আনন্দে আর স্রোতে।

সূত্রধর- সেই সোনার দেশে স্যাঁকরার দোকানে নিরেট সোনার দশগাছা মল গড়ালেন।

সূত্রধর- মল জ্বলতে লাগল যেন আগুনের ফিনকি দিয়ে , বাজতে লাগল যেন বীণার ঝঙ্কার – মন্দিরার রিনি-রিনি।

সূত্রধর- রাজা মানিকের দেশে মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে সোনার মল গড়িয়ে, মুক্তোর রাজ্যে এলেন।

সূত্রধর- দুটি পায়রা ঘুরে বেড়ায়, মুক্তোর এই দেশে
এ পায়রারা অন্যরকম চলায়, বলায় বেশে।

সূত্রধর- ২ – কেমন পায়রা তারা? করেনা বকবকম? রং কি নয় সাদা অথবা ছাইরংয়া?

সূত্রধর- তাদের মুক্তোর পা, মুক্তোর ঠোঁট
খায় মুক্তোর ফল। মজায় মজায় উড়ে বেড়ায় আকাশ বাতাস জুড়ে। যে ডিম পাড়ে তাতেও কিন্তু মুক্তো থাকে ভরে।

সূত্রধর- ২- বাবা! এ তো দারুণ মজা। গোটা রাজ্যে শুধু মুক্তো আর মুক্তো!

সূত্রধর- হ্যাঁ ঠিক তাই। সে দেশের রাণী সন্ধেবেলা গাঁথেন মুক্তোর মালা, নিজ হাতে।
রাতের বেলা মাথায় দিয়ে ফেলে দেন ভোরবেলাতে।

-আচ্ছা আচ্ছা। তারপর রাজা গেলেন কোথায়। থেকে গেলেন কি সেই রাজ্যেই?
– না না রাজা এবার মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে সোনার মল গড়িয়ে, মুক্তোর রাজ্যে মুক্তোর হার গাঁথিয়ে, ছ-মাস পরে রাজা এক দেশে এলেন।

– আবার নতুন দেশ?

– হ্যাঁ এক্কেবারে নতুন দেশ। এ দেশে রাজকন্যের উপবনে নীল মানিকের গাছে নীল গুটিপোকা নীলকান্ত-মণির পাতা খেয়ে, জলের মত চিকন, বাতাসের মত ফুরফুরে, আকাশের মতো নীল রেশমের গুটি বাঁধে।

– বা বা! আর কি করেন রাজকন্যে?

– সারারাত নীল রং এর জ্যোৎস্না মেখে ছাদে বসে থাকেন তিনি। জ্যোৎস্নার রং এ রং মিলিয়ে নীল-রংএর শাড়ি কেনেন তিনি।

– ও! আমাদের তো ভাবতেই কেমন লাগছে? সেই শাড়ি কবে পরেন রাজকন্যে?

– মহাদেব নীলকন্ঠের পুজো হয় যেদিন, সেদিনই পরেন তিনি এই ঘন আকাশ রংএর শাড়ি। ঘরে এসে সেই শাড়ি তিনি ছেড়ে ফেলে দেন।

– এতো দামি শাড়ি ছেড়ে দেন?

– হুম। দাসীরা সেই শাড়ি বেচে সাত জাহাজ সোনা পায়।

– বাবা!!!

– ঐ দ্যাখো। আমাদের মহারাজা সাত জাহাজ সোনা দিয়ে আদরিনী সুয়োরাণীর শখের শাড়ি কিনলেন রাজকন্যার দাসীদের থেকে।

– মরে যাই মরে যাই, এতো মূল্য দিয়ে এই শাড়ি কিনলেন তিনি?

– শুধুই কি কিনলেন? তারপর সাতসমুদ্র তের নদী পার হলেন। পার হলেন উত্তাল ঢেউ এবং প্রবল ঝঞ্জার মধ্যে দিয়ে, তারাভরা আকাশ আবার বজ্রবিদ্যুৎএর মধ্যে দিয়ে- পৌঁছলেন অবশেষে নিজের রাজ্যে এসে, এসেই রাজার মনে পড়ল-

রাজা- মন্ত্রী!

মন্ত্রী- বলুন মহারাজ। বড় ভুল হয়ে গ্যাছে। বড়রাণীর বাঁদর আনা হয়নি। যাও তুমি একটা বাঁদরের সন্ধান করো গিয়ে।

মন্ত্রী মহারাজের আদেশ শিরোধার্য করে চলে গেলেন, আর রাজা শেতহস্তী চড়ে লোকারণ্য রাজপথ দিয়ে ধীরে ধীরে ছোটরাণীর গহনাগাটি নিয়ে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন।

ক্রমশঃ