একটি তুলসী গাছের কাহিনী এক দেশভাগের আত্মকথন

অসীম দাস

গত ৩০.০৪.২০২২ অশোকনগর অমল আলো তে নৈহাটি সেমন্তী নাট্য দলের একটি অসাধারণ প্রযোজনা দেখলাম। একটি তুলসী গাছের কাহিনী। বাংলাদেশের কথা সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীওল্লাহ ( জন্ম.১৫ আগস্ট ১৯২২ – মৃত্যু. ১০ অক্টোবর ১৯৭১) এর এক অমর সৃষ্টি। এক অসাধারণ গল্প, যেনো বাস্তবের মাটিকে একমালায় গেঁথে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে স্বাধীনতার পর দেশভাগের সমস্যাটা একতরফা ছিলনা। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ বইতে এই গল্পটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।

আসলে তুলসী গাছের বেঁচে থাকার কাহিনি তাে মানুষেরই বেঁচে থাকার কাহিনি। কারণ সাম্প্রদায়িকতা আর দেশভাগ – হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কাউকেই রেহাই দেয় নি। তাই গল্পের শেষ কয়েকটি ছত্রে একটা দীর্ঘশ্বাসের আবহ গড়ে তুলেছেন – “সেদিন থেকে গৃহকর্তীর ছলছল চোখের কথাও কারও মনে পড়েনি। কেন পড়েনি সে কথা তুলসী গাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা। তাই বলা যায় এই ‘একটি তুলসী গাছ’-এর কাহিনিতে লেখক জীবনের মঙ্গলস্বপ্ন ও স্বপ্নবিনষ্টের প্রতীক হিসাবে গড়ে তুলেছেন তুলসী গাছটিকে, যার মাধ্যমে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে সাধারণ মানুষের ছিন্নমূল হওয়ার বেদনা।

দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এক দল ভারতীয় মুসলমান পরিবার সুখের ঠিকানার খোঁজে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন পুর্নবাসনের জন্য। আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িতে এসে ঠাঁই নেয় তারা। ওই পুরনো স্মৃতি বিজরিত বাড়িতে একটি তুলসীগাছ মানুষকে কিভাবে চিন্তায় ফেলে দেয়। একদিন দেখা যায় ওই আধমরা তুলসী গাছে কাফেরদের দেবতার গাছে জল তবে কে দিয়ে বাঁচিয়ে তুলছে ? এই চিন্তাতে সবাই সবাইকে সন্দেহ করে। লুকিয়ে সবাই নজর রাখে। সত্যিই কি সব রাগ উপরে ফেলা যায় , সত্যিই কি ধর্ম পাড়ে নির্মূল করতে মনের জ্বালাকে? এমনই অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে ভয়ে দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে শরনার্থী হয়েছিল আমাদের পিতৃপুরুষেরা । দুয়ারে দুয়ারে সরকারের ত্রাণ, সহযোগিতার জন্য ধর্ণা দিয়েছিল, একটু আশ্রয়ের খোঁজে । কিসব দিন তাহলে কেটেছে তাঁদের ! সেই সব যন্ত্রণার ইতিহাসের কথা যেনো নির্দেশক সুপ্রতীম রায় যিনি এই নাটকে স্বয়ং আলো প্রক্ষেপণ করেছেন। অমল আলোতে তা নিজের চোখেই দেখলাম। এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে আলোর সঞ্চালন বড় মায়াময়, বড় অপূর্ব লেগেছে। সুনিপুণ হাতে একটার পর একটা ছবির মতো দৃশ্য এঁকেছেন আলো দিয়ে। আবহ নির্মাতাও মনের মতোন করে মিঠে লালনের গান দিয়ে মিশিয়ে দিয়েছেন দুঃখ দৈনতাকে।

টিমওয়ার্ক দূর্দান্ত। অমল আলো ইন্টিমেট স্পেসে এই নাটক বোধহয় সেভাবে খেলানো সম্ভব হয়নি যদিও আমার ব্যক্তিগত অভিমত। প্রসেনিয়াম মঞ্চে দেখতে পেলে আরো ভালো লাগতো।  অলোক মিশ্রদার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও আন্তরিক প্রয়াস সত্যিই প্রশংসনীয়। অবশ্যই একবার প্রণাম জানাই নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় স্যারকে। এ নাটকে রূপা, ঋত্বিকদের সমবেত অভিনয় অনেকদিন মনে থাকবে।
এ নাটকের আরো অনেক অভিনয় হবে এই আশা রাখি।

2 thoughts on “একটি তুলসী গাছের কাহিনী এক দেশভাগের আত্মকথন

  1. খুব বড় মাপের ঔপন্যাসিকের কাজকে মঞ্চে ধরেছেন সুপ্রতিম। যার অধিকাংশ কাজেই সাহিত্যের উপাদান লক্ষনীয়।

Comments are closed.