অশোকনগর পত্তন থেকে আজকের সংস্কৃতি চর্চা – পর্ব ২ – অসীম দাস

সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে অনেক কিছু ঘটে, আন্দোলন হয়, চিন্তার আদান প্রদান হয় তারপর তা বিবর্তিত হয়ে একটি রূপ পায়। সমাজ এগিয়ে চলে। এ চলার পথ কখনও ধীরে ধীরে আসে আবার কখনও বা আসে তড়িৎ গতিতে, মসৃণ উপায়ে। একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় এসে মানুষ হিসেবে আমরা যে সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ন্যায়ফসল ভোগ করছি তা হঠাৎ একদিনে আসেনি। এসেছে তা অনেক কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সুধীজন দ্বারা। আমাদের কাছে দৈনিক ও আঞ্চলিক খবরের কাগজের সংবাদ সাময়িক পত্র পত্রিকায় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে এই উদযাপন, গবেষণা যা ইতিহাসের আকর। একটি সময়ের লেখচিত্র অবশ্যই।
সেসব থেকেই গবেষণা পর্বের কাজ চলছে। কিভাবে বাস্তহারা, ভূমি উচ্ছেদ, জবরদখল, বঞ্চনা, স্টেশন নির্মাণ, পৌরসভা গঠন, কোন পথে রাজনীতির অনুপ্রবেশ, পোস্টঅফিস, বাজার, বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় স্থাপন এই অশোকনগর কল্যাণগড় নির্মাণের সংযুক্ত উত্তর চব্বিশ পরগণার অশোকনগর কল্যাণগড় থেকে যে সমস্ত পত্র পত্রিকা পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল তার একটা আংশিক তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করলাম।
লক্ষ্য করেছি এই জেলার গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে এখনও অবধি যত পত্র পত্রিকার জন্ম হয়েছে তাদের অধিকাংশ হারিয়ে গেছে আমাদের চেতনার জগৎ থেকে। এই পত্রিকা নিয়ে যাঁদের মাথা ব্যথা আছে তাঁদের কাছে এটা কোনো নতুন কথা নয়। এই অবশ্যম্ভাবী অবলুপ্তিকে ঠেকানোর কোনও সঞ্জীবনী মন্ত্র আমাদের জানা নেই। আমরা যদিও বা তাঁদের জন্য রক্ত ঘাম চোখের জল ঝরাতে পারি কিন্তু তবু তাদের সবাইকে ঝরে পড়া থেকে বাঁচাতে পারি না।

অশোকনগর কল্যাণগড় নিয়ে আমার আগ্রহের সীমা নেই। যেখানে আমার জন্মস্থান, বাসভূমি সেখানটা নিয়ে অতি আগ্রহ থাকবে সেটাও স্বাভাবিক। আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকাটা প্রয়োজন বলে মনে করি। সময়ের নীরিক্ষে মানুষ মানুষের থেকে দূরে সরে গেছে, আপন পর হয়েছে, এত উত্থান পত্তন এসেছে বন্ধুত্বে , সহযাত্রীতে , প্রতিবেশীতে , রাজনীতিতে , সংস্কৃতিতে , অর্থনৈতিক শিল্পতে। সেই টানে চর্চার নেশাটাও চেপে গেছে ততক্ষণে। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধটাও। কোনটা সত্যি, কেন অশোকনগর নামকরণ ? কার নামে এই উপনগরীর নাম অশোকনগর? কারা প্রথম এগিয়ে এসেছিল, কারা কোথায় মিটিংএর আয়োজন করছিল অনেক রকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বইতে পড়েছি, শুনছি পড়ছিও। অবশ্য বিভিন্ন মতামত শুনে একটুও হতাশ হইনি ।

আসুন এবার একটু গভীরে প্রবেশ করি — বহুলাংশের মতে অশোকনগর শব্দটি এসেছে কংগ্রেস নেতা ব্যারিষ্টার অশোককুমার সেনের নাম থেকে। বামপন্থীরা অবশ্য তা মানতে নারাজ! ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বনগাঁ বর্ডারে উদ্বাস্তুদের পরিস্থিতি সরজমিনে দেখতে আসলে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের তত্বাবধানে এই উদ্বাস্তুনগরীতে পরিদর্শনের জন্য আসেন। এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান ১৯৪৮ এর ৩০ শে জানুয়ারির দাঙ্গার সময় দেশভাগের জন্য যারা এদেশে চলে এসেছেন তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে।

হরিপুর, শেরপুর (কথিত আছে শেরশাহ সূরি এই পথ দিয়ে বিহার গিয়েছিলেন) বাইগাছি এই তিনটি জায়গার নাম ছিল পূবেই। বেশির ভাগ মুসলিমরা বসবাস করত তখন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অধিকাংশ ফাঁকা জমিতে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠল সরকার। যারা ওপার থেকে আসছেন তারা প্রায় সকলেই বাঙালি হিন্দু। হাবড়া আরবান কলোনি নামে পরিচিত তখন। তারও আগে কন্ট্রোল বিল্ডিং নামেই জানত সকলে। কচুয়া মোড় থেকে শুরু হয় বাড়ি তৈরি। ১নং স্কিমে মোট দুশো বাড়ি। ছ’কাটা জমি মাপ করে সারি সারি কংক্রিটের রানওয়ে গুড়িয়ে রাতারাতি তৈরি হতে লাগলো দুই কামরার ঘর সহ পায়খানা পাকাবাড়ি। দেখতে দেখতে ৩নং,৮ নং স্কিম , ২ নং, ৪ নং ৫ নং আরো অন্য সমস্ত স্কিমের বাড়ি তৈরি হয়ে গেল।

১০ মার্চ ১৯৫০ সালে প্রথম পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে অ্যালোটি নিয়ে গৃহে প্রবেশ করলেন শিক্ষক মতিলাল সরখেল। বাড়ির নম্বর ৩৫৭/১.

কিছুদিন পর জেলাশাসক আই এস হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এই নব উপনগরীর সুন্দর একটি নামকরণের জন্য ৮ নম্বরে বতর্মান পল্লী সংঘের ময়দানে একটি সভার আয়োজন করেন। উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেস নেতা তরুণকান্তি ঘোষ, কেশব ভট্টাচার্য, ড. সাধন সেন, বিকাশ রায় চৌধুরী, ননী কর এবং চিত্তরঞ্জন বসু প্রমুখরা! তিনটি নাম সেখানে প্রস্তাবিত হয়। নব উপনগরী সমগ্র নকসা নির্মাণ করেন সরকারের পক্ষ থেকে অশোককুমার সেন। তাঁর কাজের প্রতি সম্মান ও স্মরণীয় করে রাখতে সভায় সিদ্ধান্ত হলো নামকরণ হবে অশোকনগর।

কে এই অশোককুমার সেন, কি তাঁর পরিচয়, জন্মবৃত্তান্ত আসুন একটু জেনেনি!

বর্তমানে জীবিত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য (কুমার) সেনের (জন্ম. ০৩.১১.১৯৩৩, ‘পর্ণকুটীর’, শান্তিনিকেতন) সম্পর্কে কাকা হন ব্যারিস্টার অশোককুমার সেন ( জন্ম. ১০.১০.১৯১৩ — মৃত্যু. ২১.০৯.১০৯৬ দিল্লিতে ) , জন্মস্থান পূর্ববঙ্গের ঢাকা ফরিদপুর সদর উপজেলা সোনারং গ্রাম। বাঙালি বৈদ্য- ব্রাহ্মণ , বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা।পরে অর্থনীতি নিয়ে পড়তে ইংল্যান্ডে পাড়ি। অশোককুমার সেনের বাবা অক্ষয়কুমার সেন তখন বীরভূম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। অশোকরা তিন ভাই। বড়ভাই সুকুমার সেন ভারতবর্ষের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ,ছোটভাই ডাক্তার অমিয়কুমার সেন যিনি সর্বদা রবীন্দ্রনাথের ছায়া সঙ্গী ছিলেন।

অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেন। রবীন্দ্রনাথ মা ও ছেলের দুজনারই নামকরণ স্রষ্টা , অমিতার জন্ম শ্রাবণ মাসে হওয়াতে শ্রাবণী বলেই ডাকতেন কবি। অমিতার বাবা আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন, যিনি বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় উপাচার্য ছিলেন। স্বামী ড.আশুতোষ সেন কবিগুরুর শরীরে শেষ অস্ত্রপ্রচার করেছিলেন। অমিতা ও অশোকের বাবারা দুই ভাই। ক্ষিতিমোহন সেন ও অক্ষয়কুমার সেন।

স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও রাজীব গান্ধীর আইনমন্ত্রী ছিলেন।

১৯৪৪ তে অঞ্জনা দাসের সাথে প্রেম প্রনয়ে আবদ্ধ এবং বিয়ে। কলকাতা উত্তর পশ্চিম লোকসভার সাতবারের সাংসদ।

কেউ কেউ বলছেন অশোকনগর – কল্যাণগড়ের প্রধান স্থপতি বা রূপকার কেউ একজন এমন নয়। এমনও উল্লেখ পাওয়া গেছে কারো কারো লেখায়। তাঁদের মধ্যে শিক্ষক কবি সত্য গুহ যিনি লিখেছেন—-

” আমরা বিশ্বাস করি কোনো সৃষ্টিই একজন বা কয়েকজন দ্বারা হয় না। একজন বা কয়েকজন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এবং বহুজন হিতার্থে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে তাকে সম্পূর্ণ করে অথবা ক্রম সমুন্নত করতে হাত বাড়ায়।কিন্তু আমাদের মধ্যে বৃহত্তর অশোকনগরের কোনো একজন রূপকার নেই, আছেন প্রথম দিকে ডজনখানেক উদ্যোক্তা এবং পর প্রজন্মের কিছু উল্লেখযোগ্য উপযুক্ত উত্তরাধিকারী।”

লেখক সত্য গুহ তাঁর দীর্ঘ লেখায় কোথাও একটি বারের জন্য উল্লেখ করেননি অশোককুমার সেনের কথা। এই তথ্যে বিতর্ক, মতান্তরের সূত্র লুকিয়ে আছে বলে আমার মনে হয়েছে তাই উদ্ধৃতি তুলে ধরলাম।
আরও একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নাম উল্লেখ করছি তিনিও অশোকনগরের রূপকার এই তথ্য বহু জায়গায় পাওয়া গেছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সমাজসেবী ননী কর লিখছেন —

“কালের নিয়মে সময়টা হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু এটা একটা উপনগরী গড়ে উঠেছিল ক্রমে ক্রমে। নানা প্রতিষ্ঠান, নানা সংগঠন গড়ে উঠেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে — কোনোটার আবার অকাল মৃত্যু হয়েছে। চারটি প্রজন্ম — একটা শতাব্দীর শেষ অর্ধাংশ জুড়ে নানা ঘাত প্রতিঘাতে টিকেও গেছে। তাই তো এই উপনগরীর জন্মলগ্ন থেকে পঞ্চাশ বছর সকলের কাছে অন্তত এই উপনগরীর বাসিন্দাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

‘উদ্বাস্তু বাস্তুহারা ‘ নতুন নামকরণ হলো আমাদের। ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পাবনা, দিনাজপুর, রাজশাহী — সব জেলার বেরা ভেঙ্গে সবাই একাকার। তারই একটা অংশ এলেন অখ্যাত হাবড়ায়। শুরু হলো ক্যাম্পজীবন। হরিপুর, বাণীপুর, শেরপুর পরিত্যক্ত মেলেটারি ব্যারাকে। আরও বহু লক্ষ মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে। বিভিন্ন ক্যাম্পে,ভাড়া বাড়িতে বা শিয়ালদহ সহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে দিন কাটাতে লাগলেন।

প্রশ্ন,ভবিষ্যৎ কি? পুনর্বাসন হবে — কোথায়, কবে, কিভাবে?

আমি তখন ছাত্র। ( ননী করের জন্মঃ ১ অগাস্ট ১৯৩০) ১৯৪৬ সালে নোয়াখালি ঘটনার পর যখন প্রথম বিপন্ন মানুষ আসে শিয়ালদহ স্টেশনে — তখনই আমরা একটি রিলিফ কমিটি চালাই। ১৯৪৭ সালের পর আমাদের সংগঠন এ বি আর সি (অল বেঙ্গল রিলিফ কোর) ছাড়াও অনেকগুলো ত্রাণ প্রতিষ্ঠান শিয়ালদহতে সাহায্যের কাজে অংশ নেয়। আমরাও বনগাঁ সীমান্ত থেকে শিয়ালদহ সর্বত্র যাতায়াত করছি। ধীরে ধীরে সংগঠিত করছি উদ্বাস্তুদের। তৈরি হয় নিখিলবঙ্গ বাস্তুহারা কর্মপরিষদ। যার প্রথম সভাপতি প্রয়াত নগেন দাস, সাধারণ সম্পাদক মহাদেব ভট্টাচার্য, আমি তখন শুধুমাত্র একজন কর্মকর্তা। ”

চলবে…

3 thoughts on “অশোকনগর পত্তন থেকে আজকের সংস্কৃতি চর্চা – পর্ব ২ – অসীম দাস

Comments are closed.