আসছে বছর আবার হবে | দীপা ব্রহ্ম

পর্ব – ১৮ –

এ এক অদ্ভূত উন্মাদনা। ঢাকে কাঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মন যেন নেচে ওঠে। হৃদয়ের কুঠুরিতে যতরকম আবেগ সব বেরিয়ে আসতে চায় দুটি কাঠির কারসাজিতে। ঢাক যে কোনো উৎসবের সঙ্গে এভাবেই মিশে গেছে। বাঙালির উৎসব দুর্গাপুজোর কামনায় যে যে ছবিগুলি ভাসিয়ে তোলে তার মধ্যে ঢাক অন্যতম ও অবিচ্ছেদ্য। পালটে যাওয়া রোদ্দুরের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কাশফুলের শুভ্রতাকে গায়ে মেখে দেবী দুর্গার বোধন থেকেই বাংলার নানা জায়গায় ঢাক বাজতে থাকে। কাঠের সঙ্গে চামড়ার মেলবন্ধনে তৈরি ঢাক। দুদিকে ছাওয়া চামড়ায় যখনই একটি ১৮ ইঞ্চি ও একটি ১০ ইঞ্চি লম্বা কাঠির টক্কর লাগে, সুর তাল একাকার হয়ে এক অন্য পরিবেশ গড়ে তোলে। একটি নির্জীব বাজনা এক মুহূর্তে সজীব হয়ে পড়ে। এ সব নিয়ে ভাবতে ভাবতে কথা বলেছিলাম ঢাকি নিমাই দাসের সঙ্গে। মুর্শিদাবাদ রাইহাটে তাঁর বাস। তাঁর দল ‘রাইহাট সরস্বতী ঢাক বন্দনা সম্প্রদায়’। তাঁর কথা থেকেই জানলাম, এক এক পরিবেশে এক এক রকম করে ঢাক বাজে। দুর্গাপুজোর আবাহনের পর ঢাকে বোল তুলে চলে বাজনা। তিনি ঢাক বাদ্যকে আলাদাভাবে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও কলকাতা সহ নানা জায়গায় তিনি নানা উৎসবে ঢাক বাজিয়েছেন। তাঁর দলে সদস্য সংখ্যা ২৫। গোটা দল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মেলায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁরা ঢাক বাজিয়ে বহু পুরস্কারও পেয়েছেন।

শুনলাম, এখন মেয়েরাও ঢাক বাজনায় এগিয়ে এসেছেন। নানা অনুষ্ঠানে ঢাক বাজিয়ে তাঁরা যেমন মানুষকে আনন্দ দেন তেমনি নিজেরাও আনন্দ পান। আবার বাজনা বাজিয়ে যে পয়সা পান তা দিয়ে তাঁদের সংসার চালানোরও একটা উপায় হয়। ঢাক শুধু বাজানো নয় তার সঙ্গে শরীরী নানা ভঙ্গি যুক্ত করে নিমাই দাস তাঁর বাদনকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যান। ঢাক ঘুরান দিয়ে মুলা তালে ফিরে আসা, বাজাতে বাজাতে চোখ দিয়ে, মুখ দিয়ে মাটি থেকে পয়সা ওঠানো তাঁর বাজনার মধ্যে দিয়ে দর্শককে আনন্দ দেয়। ঘাড়ে ১০ কেজি ওজনের ঢাক নিয়ে এমন সব কসরত দেখান তিনি। বাবা বিশ্বনাথ দাস তাঁর শিক্ষাগুরু। তাঁর বয়স ৬৩। এই বয়সেও ঢাকে মাতোয়ারা করেন মানুষকে।

এই জেলায় বহু শিল্পীই আছেন যাঁরা ঢাক বাজান। বেলডাঙা অঞ্চলের নিতাই দাস, গৌতম দাস আরও কত। আবার কথা হলো পুরুলিয়ার তরণি কালিন্দির সঙ্গে। তিনিও একজন ঢাকি। বংশপরম্পরায় ঢাকবাদনকে ধরে রেখেছেন। তাঁরও শেখা, বাবা ত্রিলোচন কালিন্দির কাছ থেকে। ষষ্ঠীর রাতে তাঁর বাজনা শুনলাম পুরুলিয়ার রাজবাড়িতে। ডিডিগি ডিডিগি ডিডিগি ডিগি ডিগি এভাবে শুরু করে, ডিডিগি নাগডিনাডিন ডিডিগ ডিডিগ নাগডিনাডিন ডিডিডিগ নাগডিনাডিন ডিডিডিগ ডিগডিনাডিন— এভাবেই জলদের তুঙ্গে পৌঁছে যায় তাঁর হাতের বোল। তাঁর হাতের কারসাজি আমাদেরও দুলিয়ে দিল, মনের অজান্তে। ঢাকের দোসর কাঁসি। পুরুলিয়ায় ‘বাটা’ বলে। পুরুলিয়ার শিলফোড় অঞ্চলের এই ঢাকিরা জীবন-যাপন করেন, অন্যের জমিতে চাষ করে। মনের টানে ঢাক বাদনে যে অর্থ মেলে তাতে সংসার ঠিকঠাক চলে না। তাই শুধু পুজো নয়, বিবাহ অনুষ্ঠান, মেলা, অন্নপ্রাশন যে কোনো শুভ অনুষ্ঠানে ঢাক কাঁধে ছুটে যান তরণি কালিন্দি। তাঁর ছেলে ক্যাসিও বাজায়, বাউল গান করে। এখন অতিরিক্ত ওজনের ভার কমাতে সিন্থেটিক ঢাকের ব্যবহার শুরু হয়েছে।

তরণি কালিন্দি এখনও সরকারি ভাতার আওতায় নেই, তাই কোনো সরকারি অনুষ্ঠান তিনি পান না। কত কত প্যান্ডেল, কত কত ঢাকি এই দুর্গোৎসবকে পরিপূর্ণ করছেন ঢাক বাজিয়ে। আমি জানি প্রত্যেক শিল্পীরই ঢাক বাদনের আড়ালে একটা সংগ্রাম আছে। ঢাকের নিনাদে তা আমাদের কানে পৌঁছায় না। এই ঢাকিরা যখন তাঁদের চেনা আশ্রয়ে ফেরেন, তখন তাঁর বাড়ির মানুষজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন , বছরকার দিনে তাঁর বাড়ির মানুষটি কতটা পুঁজি জোগাড়ে সক্ষম হলেন, বাহবাই বা পেলেন কতটা। ‘আসছে বছর আবার হবে’-র নিরাপত্তা কতটা পেল তাঁর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যাঁদের হাত দিয়ে দুর্গাদেবীর আবাহন হল, শব্দ সংযুক্তির মাধ্যমে তাঁরাই ইতি টানেন উৎসবের। তাই বোধহয় দুর্গাপুজো মানেই ঢাক, আর ঢাক মানেই দুর্গাপুজো।

6 thoughts on “আসছে বছর আবার হবে | দীপা ব্রহ্ম

Comments are closed.