আজ একটু অন্য কথা বলি। কোন নির্দিষ্ট আয়োজন, উদ্যোগ বা ঘটনার কথা নয়। আমার নাট্য জীবনের অতীতের বেশ কিছু ছোট ছোট অভিজ্ঞতার একটা কোলাজ তুলে ধরতে চাই। যেখান থেকে এক ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ছবি উঠে আসতে পারে। যে ছোট ছোট ছবিগুলো তুলে ধরবো যেগুলো মূলত গত শতকের শেষভাগের। সমস্ত ঘটনার আয়োজন স্থল প্রতিযোগিতামূলক নাট্যমঞ্চ। গোটা পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত সুনামের সাথে ‘একাঙ্ক’ নাট্য প্রতিযোগিতা আয়োজন করতো বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বারাসাত সংলগ্ন জনপদ হৃদয়পুরের ব্রতী সংঘ। হৃদয়পুর রেল স্টেশন সংলগ্ন এই ক্লাবটির নিজস্ব বিস্তৃত মাঠে। প্রতি বছর অত্যন্ত পেশাদারভাবে আয়োজিত হতো একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা, যা ছিল ঐতিহ্যবাহী। আমি সেখানে সাতদিনব্যাপী উৎসবের দর্শক ছিলাম বহু বহু বছর। এই উদ্যোগের অন্যতম কান্ডারী ছিলেন প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব, নাট্যকার রতন কুমার ঘোষ। প্রতিযোগিতাটি এতটাই উচ্চ মানের ছিল যে সেখানে অংশগ্রহণ করতো রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের প্রখ্যাত নাট্যদলগুলি। এই প্রতিযোগিতায় বিচারকের বিচারের পাশাপাশি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হতো দর্শক বিচার প্রক্রিয়া। প্রতি রাত্রে নাট্য উপভোগ করার পর দর্শকদের জন্য দেওয়া ফর্মে তাদের মতামত নেওয়া হতো। একটি বড় বাক্সে প্রতি রাত্রে নাটক দেখার পর দর্শকরা সেই ফর্ম পূরণ করে বাক্সে ফেলতেন।
পরবর্তীতে সংগঠকরা সেই সকল মতামতের ফর্ম সংগ্রহ করে দর্শক বিবেচনার ফলাফলও জানাতেন যা এক কথায় ছিল অভূতপূর্ব। আমার নাট্য জীবনে এই আয়োজন অনেক বড় অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করেছে। যদিও সেই প্রতিযোগিতার অাসর লুপ্ত হয়েছে এবং ব্রতী সংঘের নাট্যচর্চাও দুর্বলতর হয়েছে। আমাদের নাট্যসফরে অন্যতম উৎসবের নাম ‘হলদিয়া উৎসব’। মেদিনীপুরের তথা বাংলার সংস্কৃতি মানচিত্রে সেই সময় হলদিয়া উৎসব উল্লেখযোগ্য নাম। সেই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে নাট্য প্রযোজনা অনুষ্ঠিত হতো। নাটকের আয়োজনে দায়িত্বে থাকতো মহিষাদল মল্লার (যতদূর মনে পড়ে)। সেখানে নাট্য প্রযোজনা নিয়ে আমরা হাজির হয়েছি আর দেখেছি আয়োজকদের নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতা। উৎসবে আমন্ত্রিত নাট্যদল গুলোর জন্য যে hospitality সেই সময় দেখেছি তা শিক্ষণীয়। হয়তো আয়োজনে বাহুল্য ততটা ছিল না, তবে আন্তরিকতার কোন খামতি ছিল না। যা আমাকে পরবর্তীকালে যে কোন ধরনের উৎসব বা অনুষ্ঠান আয়োজনে অনেকাংশে সাহায্য করেছে।
এবার আসি আরেকটি অভিজ্ঞতার কথায়। নতুন শতকের প্রথম দিক থেকেই বাংলা নাট্য মহলে একটা বিষয় প্রচলন হতে থাকে। তা হল ‘সুমো থিয়েটার’। বিষয়টি সকলের প্রায় জানা। তবে যারা জানেন না তারা ভুলেও ভাববেন না যে এটি নাট্যচর্চার কোন নতুন ধারা, জাপান থেকে ছড়িয়ে পরেছে ও বঙ্গনাট্যে প্রবেশ করেছে। আসলে এই থিয়েটারের চর্চার আবিস্কার এই বাংলাতেই ঘটেছে যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরেছে জেলা থেকে জেলায়। কি মজা ও গর্বের বলুন তো! বাংলার নাট্যচর্চার এক অন্যতর পথ তৈরি হলো, মূল ব্যাপারটা কি? টাটা কোম্পানির উৎপাদিত নানা মডেলের গাড়ি বিভিন্ন আকারের ও প্রকারের হয়ে থাকে। যেখানে প্রতিটি গাড়ির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট থাকে। সেই সব গাড়ির মধ্যে অন্যতম নাম – টাটা সুমো। গাড়িটি ভারতবর্ষের বাজারে বেশ ভাল জায়গা করে নিয়েছে। এই গাড়িটির দিকে আমাদের বঙ্গনাট্য দলের নজর যায়। তারপর নানা প্রান্তে নানা দলে নানা সমীকরণ, হিসেব নিকেশ চলতে থাকে কিভাবে টাটা সুমো ব্যবহার করে সহজেই যাতায়াত করা যায় নাট্য প্রদর্শনের জন্য, যা প্রদর্শনকারী নাট্যদল ও আয়োজক সংস্থার মধ্যে এক ধরনের সহনশীল অর্থনৈতিক সাম্য তৈরি করতে পারে। এই ভাবনাকে পুরোদস্তুর কাজে লাগিয়েছে বঙ্গনাট্য অঙ্গনের প্রচুর দল যার গতিময় ধারা আজও বহমান। কিন্তু মূল শর্তগুলি যেখানে গিয়ে ঠেকলো তা হল — সাতজন বড়জোড় আটজনের মধ্যে নাট্য নির্মাণকে বেঁধে ফেলতে হবে, সুমোর মধ্যে ও মাথার ছাদের যে জায়গা রয়েছে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সেইসব নাট্যের মঞ্চসজ্জা, আলোক সজ্জার ইত্যাদি পথ তৈরি করতে হবে । ফলে আবারও আমাদের বঙ্গনাট্য ঢুকে গেল আরেক ধরনের শর্তের মধ্যে অর্থাৎ শর্তাধীন নাট্য। এই প্রথা হয়তো বা বহনীয়, সহনীয় করেছে নাট্য জগতকে কিন্তু তার বিনিময়ে হয়তো অনেক প্রযোজনার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, ডিজাইন, ধারণা, কল্পনা, প্রয়োগ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে একটা গোটা প্রযোজনার বিশুদ্ধ নির্যাস। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর ‘সুমো থিয়েটার’।
এমন নানা ঘটনা আমার নাট্যচর্চার বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে যা ধীরে ধীরে লিপিবদ্ধ করে চলেছি। এমন আরো ঘটনার কথা আগামীতে জানাবো। আশা করি এই লেখনীর মধ্যে দিয়ে বঙ্গ নাট্যচর্চার একটা বড় সময়ের চরিত্র ধরা থাকবে ‘ভবিষ্যতের জন্য’।