দীপা ব্রহ্ম
সেদিনটা ছিল একটা মেঘমেদুর দিন। গোটা আকাশময় কালো মেঘ কেবলই বৃষ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সিংহের গর্জনের মতো মেঘ রাজাও গর্জে উঠছিলেন বার বার। সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলাম হলদি নদীর ধারে, হলদিয়ায়। নদীর ধার প্রায় ফাঁকা। ওপারে নন্দীগ্রাম। তারই মধ্যে দু-একজন মানুষ চোখে পড়ল। নতুন জায়গা, একটু এগিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম—এখানে ষষ্ঠীমঙ্গল পালাগানের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ আছেন। ওদের মধ্যেই গোপাল মণ্ডল বলে একজন আমাদের হলদিয়া বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গেলেন। যেখানে পারুলদির চায়ের দোকান। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখলাম, দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ততক্ষণে গোপাল একটা ভ্যানের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। সেই আমাদের পারুলদির বাড়িতে নিয়ে গেলো। পারুলদি সবে দোকান বন্ধ করে দুয়ারে দাঁড়িয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম —
‘আপনি পারুলদি, ষষ্ঠী মঙ্গল পালা করেন?’
—’হ্যাঁ, আমি পারুল পাত্র।
ততক্ষণে বৃষ্টি ভূমিষ্ঠ শিশুর মতোই মুষলধারে নেমেছে। কোনো রকমে কথা চলছে। ছাতাও জল মানছে না।
পারুলদির থেকে জানলাম, ষষ্ঠীর দয়ায় যখন কোনো বাড়িতে শিশু জন্মানোর জন্য মানত করা হয় তখন, বা শিশু জন্মানোর পর তার মঙ্গল কামনা করেও এ পালা অভিনীত হয়। ষষ্ঠীর গল্প অনুযায়ী আঁতুর ঘরে শিশুর জন্মের ষষ্ঠ দিনে একটি পিড়ি, পাশে কলার বাসনায় ফল, মিষ্টি, ধান একটি পাত্রে। অন্যটিতে চাল রাখা হয়। ঘরের দুয়ার বন্ধ থাকে। পিঁড়িতে জল ভরতি ঘট ও একটা নতুন গামছা রাখা হয়। এ ছাড়াও কাঠের পিঁড়িতে দোয়াত-কলম, সোনা বা রূপোর গয়না রাখা হয়। রাতে এ পুজো হয়। মনে করা হয় গভীর রাতে চিত্রগুপ্ত এসে এই দোয়াত কলম দিয়ে শিশুর ভাগ্য লিখবেন। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘর আলোকিত করা হয়। পিঁড়ির সামনে একটি কাপড় বিছানো থাকে।
মনে করা হয়, চিত্রগুপ্ত ওই কাপড়ে বসে সামনে রাখা দ্রব্যগুলি গ্রহণ করবেন। নব ভূমিষ্ঠ শিশুটিকে তিনি যাতে বর দেন তারই জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়। নবজাতককে ধনরত্নের বর দেবার জন্যে সোনা, রুপো রাখা হয়, যাতে তা দেখে তিনি শিশুকে ধনরত্ন বর দেন। এ হলো লৌকিক বিশ্বাস এবং নতুন প্রাণের মঙ্গলের প্রার্থনায় নানা আচার।
ষষ্ঠীমঙ্গল পালায় যে গল্প প্রচলিত আছে, তা একেবারেই আলাদা। এক রাজার সাত রানি। এক রানিরই সন্তান হয়। অন্য রানিদের ঈর্ষা থেকে কীভাবে ষষ্ঠী মা সেই রানি ও শিশুকে রক্ষা করেন, তার নানা ঘটনা এ পালায় দেখা যায়। ষষ্ঠীর ঘট পাতা হয়। এ পালায়
যাঁরা অভিনয় করেন, সবাই এ ঘটে প্রণাম করে অভিনয় আরম্ভ করেন। পারুলদি এ পালায় রানির পাঠ করেন। মা শীতলা, শঙ্করী, মা বিশালাক্ষী দেবীকে বন্দনার মাধ্যমে তাঁদের পালা শুরু হয়। এই লোকনাটকে মূলত হারমোনিয়াম, খোল, ঢোল, বাঁশি, খঞ্জনি বাজে। এখন ক্যাসিওর ব্যবহারও হচ্ছে। প্রায় গোটা মেদিনীপুর জুড়ে এ পালা হয়। নন্দীগ্রাম, হলদিয়া, এগরা, খেজুরি, মুগবেড়িয়া, সবং, পটাশপুর, বেলদা— এই বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ ষষ্ঠীমঙ্গল পালা বা নাটকের সঙ্গে যুক্ত। কথা হলো পারুলদির দলের প্রধান লালমোহন সামন্তের সঙ্গে। পেশায় ধীবর। ভোররাতে কাঁকড়া, মাছ ধরে, সারা শরীরে আর্দ্রতার কাঁপুনি নিয়েও তিনি তাঁর প্রাণের কথা জানালেন। তাঁর বাড়ি ব্রজনাথ চক কলোনি।
রীতিমতো মহড়া দিয়ে, স্ক্রিপ্ট তৈরি করে তাঁরা এ পালায় অভিনয় করেন। কখনো মঞ্চে, আবার কখনো গৃহস্থের উঠোনে ষষ্ঠীমঙ্গল হয়। তাঁর গুরু নিরঞ্জন বাগ। শুধু ষষ্ঠীমঙ্গল নয়, শীতলা মঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল সব পালাতেই অভিনয় করতেন। পারুলদি এবং লালমোহন সামন্তের দলের নাম ‘মা শীতলা নাট্য সংস্থা। তাঁরা বছরে ৫০টির মতো পালায় অভিনয় করেন। পুরাতনী লোকজ সুর পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে এ পালায় যাত্রার প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে, জানালেন লালমোহন সামন্ত। ষষ্ঠীমঙ্গল পালায় নতুন প্রজন্মের আগ্রহও খুব বেশি নেই, তাই নতুন দলও আর সেভাবে গড়ে উঠছে না। তবে বর্তমানে সরকারি সাহায্য লোকশিল্পীদের অনেকটাই সুবিধা দিচ্ছে।
পারুলদির চায়ের দোকান খোলে ভোর ৩টেয়। বাসস্ট্যান্ডে ওই কাকভোরে আসা মানুষজনের জন্যে চা বানিয়ে তিনি পেট চালান। স্বামী জন-মজুর। সংস্কৃতির পোকাটা যখনই মাথায় ঝনঝন করে, তখন সংসার সামলিয়ে তিনি ষষ্ঠীমঙ্গল পালার মহড়ায় যান। শিশুদের মঙ্গল কামনায় অভিনয় করেন। তাঁর গুরু দলপতি লালমোহন সামন্ত জানালেন, তাঁর আশার কথা। তিনি পারুলদির মতো শিল্পী গড়ে তুলতে চান। শরীরের সিক্ততা কখনোই তাঁকে তাঁর মনের এই খোরাকি থেকে বিরত করতে পারবে না, এই তাঁর পণ। আমাদের কথা ফুরোলো, বৃষ্টিটাও থেমে গেল। লালমোহন সামন্তও তখন পা বাড়িয়েছেন বাড়ির পথে। নাছোড় বৃষ্টির মতো তাঁর কথাগুলি কানে নিয়ে আমরাও পা বাড়ালাম নাগরিক ঠিকানায়। জয় মা ষষ্ঠী। শিশুদের মঙ্গল করো মা।