কৌশিক মজুমদার
অনেকদিন আগে একবার উস্তাদ আমির খানের একটা সাক্ষাতকার পড়েছিলাম। উস্তাদজিকে জিজ্ঞেস করা হল “এত তো রাগ আছে, কোনটা গাইতে সব চেয়ে আনন্দ পান আপনি?” উস্তাদজী মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন “যতবার ‘সা’ টা ‘সা’য়ে লাগে ততবার”। এই অদ্ভুত পারফেকশন ভাল গায়ক থেকে লেজেন্ডদের আলাদা করে এক নিমেষে।
কিংবা আবদুল করিম খাঁ সাহেবের সেই পারফরমেন্স, দর্শক এসে দেখলেন খাঁ সাহেব হাঁ করে বসে। কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। সমঝদাররা কেয়াবাত কেয়াবাত বলে কেঁদে ভাসাচ্ছে। খানিকবাদে বোঝা গেল খাঁ সাহেব পিছনের পাঁচটা তানপুরার সঙ্গে নিজের গলা এক স্কেলে মিলিয়ে দিয়েছেন। আলাদা করে আর চেনার উপায় নেই। করিম খাঁ সাহেবের মৃত্যুও অদ্ভুত। ট্রেনে করে ফিরছেন। গোধুলি লগ্ন। অচেনা এক স্টেশনে হঠাৎ থেমে গেল ট্রেন। খাঁ সাহেব ব্যাস্ত হয়ে শিষ্যদের বললেন, শিগগির নেমে পড়। সময় হয়ে গেছে। স্টেশনে নেমে অজু করে নামাজ পড়ার মত বসলেন। উদাত্ত কন্ঠে ডুবন্ত সূর্যের সঙ্গে ধরলেন পুরিয়া ধানেশ্রী। গান শেষ হতেই লুটিয়ে পড়ল তাঁর ক্ষীণ দেহ। এই সব সঙ্গীতের মিথ। সত্যি মিথ্যে পরের কথা। কিন্তু ভাবতে ভারী ভাল লাগে।
আর একটা গল্প। বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব অনেক কষ্টে সিনেমায় গাইতে রাজি হয়েছেন। স্টুডিওতে এসে এক ফ্যাচাং। কিছুতেই মুড হচ্ছে না। শেষে নিজেই বললেন স্টুডিওতে এই বদ্ধ পরিবেশে গান হয় নাকি? চল গাছের তলায় বসে গাই। রেকর্ডিস্টের মাথায় হাত। তবু গাছ তলায় বসেই গাইলেন ” শুভ দিন আয়ো”। মুঘল এ আজম এর এই গান করে পঁচিশ হাজার টাকা পেয়েছিলেন তিনি। অনেক নায়ক নায়িকার চেয়ে বেশি।
আবার অনেক পরে সলিল চৌধুরীর এক গানে গাইছিলেন তরুন এক শিল্পী। কিছুতেই সুরকারের মন মত হচ্ছে না। শেষে গায়ক বললেন আমার গলাটা বরং একটু কোমল করে গাই। সুরকারের সেটা না পসন্দ। রেগে বেরিয়ে গেলেন। গায়ক নিজের খেয়ালেই গলাকে একেবারে কোমল করে গাইলেন গানটা। শেষ হতেই দেখলেন সুরকারের চোখে জল। তিনি জড়িয়ে ধরলেন গায়ককে। তারপর থেকে সেই অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়াতন শুনে কত মানুষ কেঁদেছেন তাঁর ইয়ত্তা নেই। মান্না দে পারতেন।
পারতেন লতাও। একবার ফুল অর্কেস্ট্রার সঙ্গে ফাইনাল টেক হচ্ছে। গান শুরু করতেই লতা থেমে গেলেন। সুরকার কে ছিলেন মনে নেই। লতার তখন বাইশ তেইশ বছর। বললেন “সাব,কোই বেসুরা বাজা রহা হ্যায়”। প্রবীন সুরকার ধমকে দিলেন “তুমহে জাদা পতা হ্যায়? ইস পঁচাশ মিউজিশিয়ান মে কোন বেসুরা বজায়েগা? তুম গাও।” গান শুরু করেই আবার থামলেন লতা। “মাফ কিজিয়ে সাব, ভায়োলিন মে কোই বেসুরা বজা রহা হ্যায়” । এবার একটু চমকালেন সুরকার। এত বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ধরছে কি করে? আর এই কচি মেয়ে? শেষে বললেন “তুমহি বাতাও কওন”। গান শুরু হতেই এবার লতা সোজা একজনের দিকে দেখালেন। শুধু তাঁকে বাজাতে বললেন সুরকার। অবাক কান্ড। সত্যিই সুর লাগছে না। সা টা সা হচ্ছে না। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন লতাকে। তুমি বিশ্বের সেরা গায়িকা হবে…ফলেও ছিল সে কথা।
আমার ছোটবেলায় লতা মানে জড়িয়ে যাওয়া এইচ এম ভির দুটো হলুদ গোলাপী ক্যাসেটের সেট। আর “না যেও না, রজনী এখনও বাকি”। একটু বড় হতেই অবাক হয়ে দেখলাম এই মহিলা বাংলা না জেনেও কী অনায়াসে ঢুকে পড়ছেন আমার স্বপ্নজগতে। সাত ভাই চম্পা থেকে আয় খুকু আয়। সবেতেই তিনি। একটু বড় হতেই যখন প্রথম মনে বসন্ত এল তখনও লতা ডাকতেন “লগ যা গলে” বা “ বাহোঁ মে চলে আও” বলে। সে ডাক উপেক্ষা করে কার সাধ্য। যত বয়স বেড়েছে আমার প্রতিদিনের জীবনে লতা সম্পৃক্ত হয়েছেন দেহেরই এক অঙ্গের মত, যা থাকলে বিশেষ বোধ হয় না, কিন্তু এই যে আজকের না থাকা, এই অদ্ভুত শূণ্যতা তৈরি করে চলেছে ক্রমাগতঃ। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও রেওয়াজ করতেন। প্রতিভাকেও শাসনে রাখতে হয়, নইলে বিপথে যায়। লতা জানতেন। আর জানতেন বলেই পাকিস্থান তাজমহলের সঙ্গে একমাত্র তাঁকেই চেয়েছিল একবার। বলেছিল, সব নিয়ে নাও। এইদুটো আমাদের দাও। কিন্নরদের কন্ঠ কেমন হয় তা জানি না। তবে আমি নিশ্চিত আমরা সৌভাগ্যবান যারা এই অসহায় পৃথিবীর মরমানুষ হয়েও জীবনে একবার লতার গান শুনতে পেয়েছি।
ভাল থাকবেন। আলো আলো থাকবেন সুরের সম্রাজ্ঞী।