নাটক ও যতিচিহ্ন | সৌম্যেন্দু ঘোষ

সাহিত্যে যতিচিহ্নের, ব্যবহার খুবই সুনির্দিষ্ট। নাটক যেহেতু সাহিত্য এখানেও যতিচিহ্নের ব্যবহার নির্দিষ্ট ভাবেই রয়েছে। নাটকের পাঠককে যেমন যতিচিহ্ন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতেই হবে। নাট্যের অভিনেতাকে সম্ভবত তার চেয়ে একটু বেশিই অভিজ্ঞতালব্ধ হতে হবে। পৃথিবীর সকল ভাষাতেই গদ্যের পূর্বে কবিতা রচিত হয়েছে। বাংলা কবিতায় সম্ভবত দুটিমাত্র যতিচিহ্ন ব্যবহৃত হতো। যেমন, মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।

বোঝাই যাছে পূর্ণচ্ছেদ বা দাঁড়ি এবং দুটি দাঁড়ির ব্যবহার সংস্কৃত থেকে এসেছে, ইংরেজি থেকে আসেনি। বাংলা নাটকে দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ রয়ে গেল, দুটি দাঁড়ির প্রচলন আর রইল না। ইংরেজিতে Full stop, একে period ও বলা হয়ে থাকে। বাক্য শেষ হলে এই যতিচিহ্নটি ব্যবহৃত হয়। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’তে সর্দারের উক্তি। — ‘এ পাড়ায় নন্দিনীর সঙ্গে যেন কিছুতে মিলতে না পারে।’ বঙ্গ সাহিত্য, নাটকে তো বটেই পরবর্তী সব ক’টি আলোচ্য যতিচিহ্ন সরাসরি ইংরেজি থেকে এসেছে। এখনও নামকরণের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের পরিচয় বহন করে যাচ্ছে। যতিচিহ্নের ব্যবহারেই বাক্যের মধ্যে বিভিন্ন ভাব সার্থক ভাবে প্রকাশ করা হয়। প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রীরই মাতৃভাষার সমস্ত যতিচিহ্ন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা অতি আবশ্যক। বাংলা ভাষায় প্রায় ২০ টির মতো যতিচিহ্নের ব্যবহার আছে। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি বলতেন, ‘বাক্যের মধ্যে কি দাঁড়ি, কমা নেই? অর্থ বোঝবার জন্যে এসবের ব্যবহার করা উচিত।’ দাঁড়ির পরেই কমা, বাক্যের মধ্যে সামান্য সময়ের জন্যে থামার প্রয়োজন অনুভূত হলো ‘কমা’ (comma) ব্যবহার করা হয়। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ-এর নাটক ‘বঙ্গের প্রতাপ- আদিত্য’ নাটকে আকবরের উক্তি। ‘মানসিংহ, বীরবল, ভগবানদাস, টোডরমল প্রভৃতি মলিনদর্পণে প্রতিফলিত হয়ে এই পাঁচজন মোগল, পাঁচকোটির আবছায়া ধারণ করে আছে।’ ‘কমা’র বাংলা ‘পাদচ্ছেদ’ বলে কোথায় যেন উল্লেখ দেখলাম, তবে শব্দটি জনপ্রিয় হয়নি। কোলন (colon) এই যতিচিহ্নটি দুটি ভিন্ন ‘উপবাক্য’কে জুড়ে দিতে সাহায্য করে। বা বলা যেতে পারে অপূর্ণ বাক্যটির পর অন্য একটি বাক্যের অবতারণা করতে এটি ব্যবহৃত হয়। বোধহয়, কেউ এর বাংলা করেননি, বাংলা ভাষায় এটির ব্যবহার প্রায় হয় না বললেই চলে।

উৎপল দত্তের ‘মহাবিদ্রোহ’ নাটকের পঞ্চম দৃশ্যটির শুরুতে এইভাবে লেখা আছে। দিল্লীর রাজপথ: গার্স্টিন গলি। সেমি কোলন (Semi colon) বাংলায় কেউ কেউ একে অর্ধচ্ছেদ বলেছেন শব্দটি অবশ্য জনপ্রিয় হয়নি। এই যতিচিহ্নটি দুটি উপবাক্যকে শুধু জুড়েই দেয় না, তাদের মধ্যে সম্পর্কটিকে আরও নিবিড় করে।  রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ থেকে গোঁসাই এর উক্তি। ‘এ কি কম কথা; আশীর্বাদ করি, সর্বদাই অবিচলিত থাকো; তা হলেই ঠাকুরের দয়াও তোমাদের পরে অবিচলিত থাকবে।’ অ্যাপসট্রফি (Aprtsophe), অক্ষর বাদ দেওয়ার যতিচিহ্ন বা সম্বন্ধপদের চিহ্ন। অনেকে একে বাংলায় উল্টোকমাও বলে থাকেন। ওপরের উদাহরণে তোমাদের ‘পরে মানে তোমাদের ওপরে। এখানে ‘ও’ অক্ষরটি বাদ গিয়ে এই যতিচিহ্নটির প্রয়োগ হয়েছে। কোলন ড্যাশ (colon Dash) ক্রমশ অবলুপ্ত হচ্ছে বাংলায়। শুধু কোলন ব্যবহার করে কাজ মিটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

জিজ্ঞাসার চিহ্ন (Note of Interogation) এটিকে Question Markও বলা হয়। জিজ্ঞাসা-চিহ্ন, প্রশ্ন চিহ্ন, প্রশ্নবোধক চিহ্ন, জিজ্ঞাসাসূচক চিহ্ন প্রভৃতি নামেও বাংলায় ডাকা হয়। ব্রাত্য বসু’র ‘মীরজাফর’ নাটকে মীরজাফর-এর সংলাপ। ‘কে? ওকে? ওকি? একি আবার সেই সিরাজের ছিন্ন শির? রক্তাক্ত দেহ? সিরাজের কবন্ধ। যাও সব, আমি বিশ্বাস করি না। ওই তারা আবার আমায় ঘিরে নাচছে (চিৎকার করে) চলে যাও।’ রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ থেকে নন্দিনীর উক্তি, ‘ওরা কারা?’ মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’ থেকে রাজার উক্তি। ‘বটে? তাই ও এ বিষয়ে এত উদ্যোগী হয়েছিল?’

বিস্ময় বোধক চিহ্ন (Note of Exclamation) বিস্ময় সূচক চিহ্ন বাংলায় এবং ইংরেজিতে এক্সক্ল্যামেশন পয়েন্ট (Exclamation point) ও বলা হয়। উৎপল দত্তের ‘শোনরে মালিক’ নাটক থেকে প্রশান্ত বাবুর সংলাপ। ‘কুমারেশবাবু, আপনার রাজনীতি দিবালোকের মতন স্পষ্ট হয়ে গেছে আমাদের সামনে!’ এই একই নাটককার অভিনয়ে অতিরিক্ত বিস্ময় বোঝানোর জন্যে কখনও কখনও দুটি বা তিনটি বিম্ময়সূচক চিহ্নের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, অবশ্যই কোনও ব্যাকরণবিদের তোয়াক্বা না করেই। ‘মানুষের অধিকারে’ নাটকে বিল-এর উক্তি। ‘গ্রেপ্তার!! আমাদের? পরে এই নাটকেই ক্যালহানের উক্তি। ‘মিস্টার লিবোভিট্‌স্!!! এসব কি বলছেন? ব্যাকরণ হয়তো মানেননি, তবে অভিনেতা কতখানি বিস্মিত হবেন সেটা তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পারবেন। পাঠকেরও বুঝতে সুবিধা হবে বিস্ময়ের সঞ্চার ঠিক কতখানি হয়েছিল, ক্যালহানের।

উধৃতি চিহ্ন (Quotation Mark) কাকপদ, যুগল উধৃতি চিহ্ন। বাক্য বা পংক্তি সরাসরি কোনও রচনার মধ্যে হলে, সেই উধৃত অংশটুকু এই যতিচিহ্নের, দ্বারা বোঝানো হয়। যেমন, রামায়ণ তর্করত্নের ‘নব নাটক’ থেকে বিধর্ম এর সংলাপ। হাঁ “শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ”। উমেশ চন্দ্র মিত্রের ‘বিধবা বিবাহ’ নাটকে বসুমতীর উক্তি। ‘… না ভাই আসি যাই, অনুগ্রহ করে এই অনেক। কথায় বলে, “রাজায় রাজায় ঝগড়া হয়, উলুখাঁকড়ার প্রাণ যায়” কি করতে কি হবে, লাভ হতে অভাগিনীর প্রাণটা যাবে।’ সমকালের নাটককারদের মধ্যে উধৃতি চিহ্ন ক্রমশই Single inverted comma’য় পর্ববসিত হতে চলেছে। নাটকের মধ্যে কবিতা বা নাট্যাংশ থাকলে সেখানে এই যতিচিহ্ন ব্যবহৃত হয়।

উধৃতি চিহ্ন, যখন single inverted comma হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে মোড়ল-এর উক্তি। ‘রঞ্জন ধরলে গান। ওরা বললে, ‘মাদল পাই কোথায় ?’ ও বললে, ‘মাদল না থাকে, কোদাল আছে।’ তালে তালে কোদাল পড়তে লাগল; সোনার পিণ্ড নিয়ে সে কী লোফালুফি। বড় মোড়ল স্বয়ং এসে বললে, ‘এ কেমন তোমার কাজের ধারা?’ রঞ্জন বললে, ‘কাজের রশি খুলে দিয়েছি, তাকে টেনে চালাতে হবে না, নেচে চলবে।
এটি Quotation mark-এর মতই উধৃতি চিহ্ন। দুটি করে ‘কমা’র বদলে এখন একটি করে কমার চলনই বেশি। ব্যবহৃত আগে পরের ‘কমা’ দুটি উল্টানো থাকে। Invert (উল্টানো) থেকে শব্দটি এসেছে বলে, মনে হবার যথেষ্ট কারণ আছে।

সংযোজক চিহ্ন (Hyphen), দুটি শব্দ বা শব্দাংশের সংযোজক চিহ্ন। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ-এর নাটক ‘আলিবাবা’ থেকে আলিবাবার সংলাপ। ‘হুসেন- মরজিনার শাদি দিতে পারলেই সব লেঠা চুকে যায়।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকে বিশুর সংলাপ। ‘যখন খোদাইকরদের সঙ্গে থাকি তখন কথায়-বার্তায় সর্দারকে সামলে চলি।’ উৎপল দত্তের ‘সূর্যশিকার’ নাটকে ঊর্মিলার সংলাপ। ‘মহারাণী ঊর্মিলা তার সব মান-অপমান ধূলায় মিশিয়ে তোমার কাছে করজোড়ে একটি ভিক্ষা চাইছে, হয়গ্রীব।’ নাটককাররা সকলেই একই কারণে এই যতিচিহ্নটির ব্যবহার করেন নি। তিন সময়ের তিনজন নাটককারের থেকে তিনটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো।

উপবৃত্ত (Ellipsis), হলো এমন একটি যতিচিহ্ন যেখানে এক বা একারিক শব্দকে বাক্যের মধ্যে উহ্য রেখে বাক্য গঠন করা হয়। বা গঠিত সেই বাক্যটিকেও এটি বলা হয়ে থাকে। তিনটি Dot বা ফুটকির সাহায্যে বাক্যের মধ্যে শব্দটিকে উহ্য রাখার কৌশল এই যতিচিহ্নটির সাহায্যে করা হয়ে থাকে। উৎপল দত্তের নাটক ‘ব্যারিকেড’ থেকে, লিপার্ট-এর উক্তি। ‘ফ্রাউ… ফ্রাউ… ৎসাউরিৎস, আপনার স্বামীকে খুন করেছিল এই হিংস্র জীবটা… সুতরাং আপনি নিশ্চয়ই… খুবই… খুবই খুশি এই দৃশ্য দেখে।’

বিকল্প (Slash), ইংরেজিতে এই যতিচিহ্নটিকে oleligue, Virgule ও বলে। কোনও শব্দ যখন অন্য একটি শব্দের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাকে বিকল্প চিহ্ন বলা হয়। ‘অথবা’ শব্দটি ব্যবহার না করে এই চিহ্নটি ব্যবহার করা হয়। ড্যাশ (Dash) একটি যতিচিহ্ন। এটি অন্ততঃ তিনভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক, ‘অতিমারির এই সময়কালটি ২০১৯-২০২১ সাল বলা যেতে পারে।’  দুই, ‘হাওড়া–ব্যান্ডেল লাইন বা শিয়ালদহ-নৈহাটি লাইন দুদিকের ট্রেনেই প্রচন্ড ভিড়।’ তিন. মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘সুন্দর’ নাটকে সৌরভের, উক্তি। ‘হ্যাঁ। প্রথম শর্ত — আমি যা বলব তা করতে হবে।’ ড্যাশ-এর জন্যে খুব অল্প হলেও একটু সময় থাকতে হয়। গেরাসিম লেবেদেফ্ এর নাটক ‘কাল্পনিক সংবদল’- এ রাম সন্তোষের উক্তি। ‘হঁ, আমার সোনার চাঁদ, অদিস্বী ঠাকুরাণী! এ তোমার গরিব দীনদাস রামসন্তোষ; যে মরিতেছে — এ তা বলি শুন – সে মরিতে চায় তোমার পাদপদ্মে।

লঘুবন্ধনী (paren thesis) বা First bracket বা প্রথম বন্ধনীও বলা হয়। লঘুবন্ধনী নানা ভাবে নানা নাটককার ব্যবহার করেছেন? নাটককার ব্রাত্য বসুর ‘মীরজাফর’ থেকে কয়েকটি উদাহরণ। লুৎফুন্নেসার উক্তি। (হেসে বলেন) নবাব মীরজাফর আর নবাব জাদা মীরন, আমি আজীবন হাতির পিঠে চড়েছি। আর থেকেছি বাঘের সঙ্গে। (আরিফা উত্তর দেয় না। হঠাৎ সে যেন বাইরে কিছু দেখতে পায়। সে ডেকে ওঠে)’ ‘মীরজাফর ‘না’, ‘না’ বলতে বলতে ওঠেন। (মীরন ওকে তাড়া করে। সভার মধ্যে দুজনে দৌড়ায়। মীরন দৌড়ায়। মীরন মীরজাফরকে ধরে ফেলে। টানাটানি হয়। আবহ আসে। রায়দুর্লভ ঢোকেন। হাতজোড় করে। প্রায় কাঁপছেন রায়দুর্লভ। ওনাকে দেখে সবাই হাসে) নাটককার লঘুবদ্ধনীকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছেন। লিখিত নাটকের মধ্যে চরিত্রের আগমন, প্রস্থান, পদাঘাত, হস্তধারণ প্রভৃতি নানা সময়ে এর ব্যবহার ঘটে। নাটককার, নাটকের মধ্যে কিছু নির্দেশ দিলেও এর ব্যবহার আছে। ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘পদ্মিনী’ থেকে। (পশ্চাৎ হইতে আলমাস বেগ ও সৈন্যগণের প্রবেশ ও উজিরকে বন্দিকরণ)

দ্বিতীয় বন্ধনী (Second bracket) বা ধনু বন্ধনী। এই বন্ধনীর ব্যবহার মূলত গণিত শাস্ত্রে। নাট্য সহিত্যে এর খোঁজ পাওয়া যায় নি। তৃতীয় বন্ধনী (Third bracket) বাংলা নামও আছে ‘গুরুবন্ধনী’। নাটকে এর ব্যবহার কচ্চিৎ কদাচিৎ আছে। ব্রাত্য বসুর ‘মীরজাফর’ থেকে উদাহরণ। বিরতির ঠিক আগের অংশ। [ ভেরি বাজে। আবহ আসে। সঙ্গে সঙ্গে বিকেলের আসরের নামাজের আজান। তার সঙ্গে ক্রাইভ আর ওয়াটসের পায়ের বুটের শব্দ মেশে। তারপর তাদের দীর্ঘছায়া রাজ দরবারে ঢোকে। মীরজাফররা বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পর্দা পড়ে ] সবেমাত্র যাঁরা অভিনয়ের শিক্ষার্থী, নাটকের পাঠক তাঁদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী একটি কাজ। পথ চলতে যেমন পথ চলার কতকগুলি নিয়ম মানতে হয়। যতিচিহ্ন চিনে এবং বুঝে সেই অনুযায়ী পাঠ বা অভিনয় তেমনি নিয়মের মধ্যেই পড়ে। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির কথা দিয়েই শেষ করি। অভিনয় শিক্ষার্থীদের তিনি প্রায়ই মনে করিয়ে দিতেন, ‘চোরা দম নিয়ে বল… pause দাও না কেন? বাক্যের মধ্যে কি দাঁড়ি, কমা নেই?’