একটা সময়ের গল্প করা যাক। নিতান্ত হেলাফেলা থেকে যার শুরুয়াত। হোমোস্যাপিয়েন্সের অগোছালে আগুন আবিষ্কারের মতো অনেকটা। আনুমানিক প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগে বুঝে না বুঝে অভাবনীয় কান্ডটি বাঁধিয়ে ফেলেছিল অর্ধনগ্ন মনুষ্যগণ। ঠিক তেমনি, কতকগুলো চ্যাংড়ার দল, দলবদ্ধ উচ্ছ্বাসের তাড়নায় নাটক শুরু করেছিলাম, বুঝে না বুঝেই। সেটাকে শুরু বললে ভুল বলা হবে না নিশ্চয়ই । আগুনের প্রয়োজনীয়তার মতোই তার তাপ উত্তাপ ব্যবহার নিত্যদিনের অপরিহার্যতাকেই বয়ে নিয়ে গেছে, যাচ্ছে, যাবে, কখনো কোটালে ভরা, আবার কখনো ফল্গু স্রোতের মতো।
তবুও, আজকের সময়টা একটু অন্যরকম। বল্গাহীন ছোটাছুটি, দাপাদাপি, কিছুই অবশিষ্ট নেই। ছোট নাটকের আসরই বলি আর, বড় নাটকের প্রাতিষ্ঠানিক রমরমাই ধরি না কেন, সবটাই এখন সুতিকা রোগাক্রান্ত থিয়েটার প্রেমিকাকে ভালোবেসে মরে যাবার আকূতি। অভাব তাহলে কোথায়? বাংলার রাজনৈতিক পালা বদলই কি একমাত্র কারণ? কিংবা, অন্য কোনো অনীহা? না। রাজনৈতিক পালাবদল অবশ্যই একটা গুঢ় কারণ, সবটা নয়। পালাবদল না ঘটলে কি হতো, হতে পারতো, সবটাই অনুমান ভিত্তিক আলোচনার কূটকচালি। থিয়েটারের ভবিতব্য যে এমনটাই নিহিত ছিল তার সূত্রমুখের ছবিটি নব্বইএর দশক থেকেই প্রচ্ছন্ন আঁকিবুকিতে ধরা পড়েছিল। পাঠককুলের যে অংশের মধ্যে একবগ্গা বামাচারীতা বিদ্যমান, তারা আমার মতামত গ্রহণ নাই করতে পারেন। পাঠকের গণতান্ত্রিক অধিকার। আমিও গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে যাবো না। রাজনৈতিক পালাবদল যে সবটা নয় তার কয়েকটি ব্যাখ্যা সাজাই।
নব্বইএর মাঝামাঝি উদার অর্থনীতির প্রবল মেরুকরণে নাভিশ্বাস উঠে গেলো দেশীয় শিল্পের। এমনকি, সরকারি শিল্পও ধীরে ধীরে কোনঠাসা। মধ্যবিত্ত বাড়ির ধার করা বাবুটি ধার মেটাতে গিয়ে যেমন সংসারে কাটছাঁট করেন তেমনি, সরকার বাহাদুরও শুরু করলেন কাটাকুটি। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি এই অজুহাতে প্রত্যেকটি কল কারখানায় শয়ে শয়ে অবসরের পর, নিয়োগ বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। ফলত, আট দশ হাজার শ্রমিক নিয়ে কর্মরত সচল কারখানাগুলি দু’তিন বছরের মধ্যেই চার পাঁচ হাজারে দাঁড়ালো। এরপরেও টুকটুকিয়ে সবটাই চলছিল। বিংশ শতকের শেষে প্রাইভেটাইজেশনের উদার উন্মত্ত খেলায় সরকারী সংস্থাগুলোর দরজাও বন্ধ হতে থাকলো। ব্যস, হাতে পাতে ভাতে টান পড়তেই একটু একটু করে সরকারি অফিসক্লাব সংগঠনগুলিও ব্যয়বহুল নাট্যোৎসব এবং, প্রতিযোগিতাগুলি গুটিয়ে ফেললেন। জৌলুসময় এমনই কয়েকটি সংগঠন, ফারাক্কা ব্যারেজ রিক্রিয়েশন সেন্টার, ধানবাদ ফুয়েল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, রুপনারায়ণপুর হিন্দুস্তান কেবলস্, ত্রিবেনী ট্যিসু, দুর্গাপুর এম এম সি এসোসিয়েশন, কুলটি স্টিল অথরিটি এমন অনেক অফিস সংগঠন। এ সবটাই ঘটছে নব্বইএর মাঝামাঝি থেকে গত শতকের গোড়া পর্যন্ত।
এ তো গেলো গত শতাব্দীর শেষ দশকের অফিস সংগঠনের সারাবাংলা আয়োজনের চাল চরিত্তির। যে সব সরকারি ক্লাব সংগঠনগুলি সংস্কৃতির প্রসারে এমনকি, বছরে একটিবার নিজেদের কলকারখানার শ্রমিকদের নিয়ে নাট্যঘন আনন্দমেলার আয়োজন করতেন। কিছুমিছু সাম্মানিকের বিনিময়ে বিভিন্ন দক্ষ নাট্যদলের চলতি সফল নাটকের পান্ডুলিপি নিয়ে এসে, নিজেদের প্রযোজনা দিয়ে উৎসবকে আলঙ্কারিক করতেন, বাইরের থেকে নামী নির্দেশককে আমন্ত্রণ জানাতেও কার্পণ্য করতেন না, প্রবল কাটলমেন্টের ফলে তাদের বাৎসরিক আয়ও নেমে এলো তলানিতে। চাঁদা সংগ্রহে দেখা দিলো ভয়াবহ ঘাটতি। কয়েকটা বছর ধুঁকতে ধুঁকতে কোনো রকমে উৎসবগুলো চালাতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলার দশা।
গোদের উপর বিষফোঁড়া, এই সব কারখানার নব্য ম্যানেজমেন্টের দলও সংস্কৃতি, কৃষ্টি, এসব বিষয়ে যারপরনাই উন্নাসিক। উপায়ও নেই। সরকার বাহাদুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যতটা সম্ভব কম লোক দিয়ে বেশি বেশি কাজ করিয়ে আয় বাড়াতে হবে। ফেলে রাখো ওসব সংস্কৃতি ফংস্কৃতি। যতদিন এমনতর কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি ততদিন, ম্যানেজমেন্টও সহযোগিতা করতেন। মহড়ার সময়গুলোতে ইউনিয়নের অনুরোধে উপরোধে অভিনেতাদের এক আধবেলা ছাড়ও দেওয়া হতো। নয়া অর্থনীতির সাঁড়াশি আক্রমণে ম্যানেজমেন্টও ঝুঁকি নিতে ভয় পেলেন উপরওয়ালার চাপে। তদুপরি, এইসব আমলাদের এমনই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে প্রত্যেকে এক একটা রোবটম্যান তৈরি হয়ে ওঠে। হলোও তাই! তাদের ভাবটা এমন, নাটক খায় না মাথায় দেয়? ওসব করে কিৎসুটি হবে না। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পশ্চাৎ উপুড় করে শুধু কাজ করে যাও। ফল স্বরূপ, কারখানায় চাকরিরত ভালো ভালো অভিনেতাকুল পড়লেন ফাঁপড়ে। বেশিরভাগই দুর দূরান্তের ডেইলি প্যাসেঞ্জার। ছুটির পর গাড়ি ধরে বাড়ি ফিরতেই রাত আটটা নটা বেজে যায়। পরেরদিন পুনরায় নাকেমুখে গুঁজে অফিস। ছুটির পর মহড়ায় তারা আপত্তি জানাতে বাধ্য হলেন। শেষমেশ বাড়ি ফিরতে ফিরতেই বারোটা বেজে যাবে। পরেরদিন সকালে উঠে দৌড়ঝাঁপ। এবাদেও, এইসব ভালো ভালো অভিনেতারা নিজের নিজের এলাকায় সফল অসফল গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এতদিন দলের গায়ে আঁচও লাগেনি। ছুটির পর মহড়া চললে দলগুলো পড়বে বিপাকে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে তারা মুখ ঘুরিয়ে নিতেই কারখানার অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন বিভাগগুলো উৎসবে অংশগ্রহণ করতেই পারলেন না। বেশ কিছু বছর টালমাটাল অবস্থায় চালাতে চালাতে এক সময়ে সবটাই বন্ধ হয়ে গেলো। আর, এসবই ঘটেছে গত শতাব্দীর শেষ থেকে এই শতাব্দীর শুরুর পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে। এমনই কতকগুলো সংগঠন হলো, কোলাঘাট থার্মাল, ইছাপুর মেটাল, ইছাপুর রাইফেলস্, কাঁচরাপাড়া রেল, কল্যানী এন্ডরুলস্, দুর্গাপুর স্টিল প্রভৃতি। কারখানার ভেতরেও পড়লো ভাঁটা।
তাতেও খুব একটা অসুবিধা ছিলো না প্রতিষ্ঠিত দলগুলির। বাউলিয়া চলার পথে আউলিয়া সুরের মেঠো আবেশ তখনও তাদের গায়ে মুখে মাখানো। প্রতিযোগিতা আর উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ করে কিঞ্চিৎ আয়টুকুও তারা রক্ষা করছেন যক্ষের ধনের মতো। হলে কি হবে, ততদিনে টিভি মিডিয়ার দাপট চতুর্দিকে। শহরতলি ঘরমুখো। নব্ ঘোরালেই নানান মনোরঞ্জক চ্যানেল। গ্রামগঞ্জ কিছুটা হলেও উৎসবমুখর আঙিনায় ভিড় জমাচ্ছে। এমন অবস্থায় ছোট নাটকের দলগুলো প্রযোজনাকে আরও জৌলুসময় করে তুলে টিভিমুখো দর্শককে ফিরিয়ে আনতে প্রাণাতিপাত চেষ্টা চালাচ্ছেন নিরন্তর। থিয়েটার যাদের সর্বাঙ্গে আঁকড়ে ধরে আছে লাউডগার মতো, সেইসব সর্বংসহা যোদ্ধার দলের একটাই জেদ, দর্শককে থিয়েটারে ফিরিয়ে আনতে হবেই। পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগতে গিয়ে দেখা গেলো, বেশিরভাগ ভালো প্রযোজনাগুলোই ব্যয়বহুল।
একদা, যেকোনো প্রতিযোগিতার আসরে প্রায় নাটকেই একই আবহ বাজতো। সবে ধন নীলমণি আনন্দশঙ্কর, স্পেকট্রাকুলার সাউন্ড এফেক্টই দলগুলোর তখন ভরসা। এলো গুগল। সার্চ করলেই পৃথিবীর যাবতীয় এফেক্ট হাতের মুঠোয়। ভালো ভালো দলগুলো ছুটলো স্টুডিওতে। দরদাম করে ভাড়া দিয়ে আবহ নির্মাণ তো করলোই, প্রথিতযশা আলোক শিল্পীকে দিয়ে ডিজাইন করাতে গিয়ে ভালোই ব্যয় হতে লাগলো। নব্বইএর আগে একটি সুপ্রযোজনা নির্মাণ করতে দু থেকে তিন হাজার টাকাতেই যথেষ্ট। গত শতাব্দীর শেষ লগ্নে এসে এক একটি প্রযোজনা নির্মাণ শেষে দেখা গেলো ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় চার থেকে পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। অথচ, প্রতিযোগিতা এবং উৎসবগুলি থেকে দেয় অর্থের পরিমাণ সেই মান্ধাতার আমলেই পড়ে আছে। দিশাহারা অবস্থা দুপক্ষেরই।
এবার, রাজনীতির কথায় আসা যাক। বাম জমানায় নাট্য আকাডেমি গঠনের প্রারম্ভেই তিনশটি রেজিস্টার দলকে দেওয়া হতো তিন হাজার টাকা। একই দল প্রতিবছর পেতো না। সারা বাংলার সমস্ত দলগুলোকে দিতে হলে বস্তা ফাঁকা হয়ে যেতে বাধ্য। নিয়ম অনুযায়ী এক একটি দল তিনবছর অন্তর পাবে। পরবর্তীতে অর্থাৎ, এই শতকের গোড়ার দিকে বেড়ে হলো সাত হাজার টাকা। অথচ, আয়োজক সংগঠনগুলোর কথা সরকার ভাবলেনই না। এমন কিছু সংঘটন তখনও কর্মরত যাদেরকে অনায়াসে সাম্মাণিকের তালিকাভুক্ত করা যেতো। অর্থাৎ কিনা, তিনশটি দলের মধ্যে কমপক্ষে একশটি আয়োজক সংস্থাও এই অর্থসাহায্য পেতে পারতেন। এই মূহুর্তে অন্তত দুটো সংঘটন আজও সরকারি দক্ষিণা ব্যতিরেকেই মনের টানে ধারদেনা করে হলেও নাট্যোৎসব চালিয়ে যাচ্ছে। তারা হলো, সঞ্জয়ের নেতৃত্বে কোলাঘাট এবং, কাশির নেতৃত্বে রসুলপুর জয়যাত্রী। একমাত্র বেথুয়াডহরী দেশবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারই আর্থিক ভাবে সাবলম্বী সংগঠন, যারা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। বাকি সংঘটক দলগুলো প্যাসেজমানি যোগাতেই হিমশিম। তার উপর, প্রতিযোগিতার পুরস্কার স্বরুপ অর্থমূল্য বাড়াতেও তারা অক্ষম। ভালো ভালো দলগুলো আর্থিক কারণেই প্যাসেজ- মানি বাড়ানোর জন্য সংগঠন গুলোকে চাপাচাপি শুরু করে দিলো। শেষমেশ মুখ থুবড়ে পড়লো উৎসব এবং, প্রতিযোগিতার রমরমা।
এ তো গেল আর্থিক দিকের মূল্যায়ন। তিতিবিরক্ত দলগুলো নব্বইএর মাঝামাঝি থেকেই একটু একটু করে প্রতিযোগিতা বিরোধী হয়ে উঠছে। বেশিরভাগ বামপন্থী নাট্যবিশারদদের অদ্ভুতুড়ে নাট্যভাবনাই এর মূল কারণ। একটি কঠিন সত্য তুলে ধরলেই আশা করবো সবটাই জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে যাবে। উনিশশো একানব্বইতে সংঘমিত্রায় থাকাকালীন ‘এই তো সময়’ প্রযোজনাটি করেছিলাম। একই বছর উত্তরপাড়া সীমান্তিকের প্রযোজনা, ‘দুঃখ সুখের গল্প’, ইউনিটি মালঞ্চর প্রযোজনা, ‘হনুয়া কা বেটা’। যেখানেই গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকার বিচারক থাকতেন, সেখানেই এই তো সময় আর হনুয়া কা বেটা কম বেশি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় স্থানে থাকত। দুঃখ সুখের গল্পের স্থান থাকত তৃতীয়তে। অথচ যেখানে গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকার বিচারক থাকতেন না, বাংলার বাছাই করা শ্রেষ্ঠ নাট্যজন বিচারক হতেন, সেখানে সবার উপরের স্থান দুঃখ সুখের গল্পর। বাছাই করা সেই সব গুণীদের নামোল্লেখ করলেই বোঝা যাবে তাঁরা কতখানি সর্বজনগ্রাহ্য এবং পন্ডিতপ্রবর। তাঁরা হলেন যথাক্রমে, ডঃ দর্শণ চৌধুরী, বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, ফিরদৌস সাজ্জাদ, ডঃ সনাতন গোস্বামী, ললিত কোনার, এমন অনেক নাট্যবিক্ষায় সৃজিত ব্যক্তি, যাঁদের নাট্যমনন নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহ হলো, এই সমস্ত গুণীজন কোনো ভাবেই ভুল করতে পারেন না। সৌভাগ্য ক্রমে নাটকটি দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম! ছোট থিয়েটারে এমন সেলুলয়েড এর আগে তৈরি হয়েছে কিনা মনে তো পড়ে না। শুধুমাত্র কোলাজের পর কোলাজে বস্তির জীবন যাপন মূর্ত হয়ে উঠেছে। কোনো স্টেটমেন্ট তো নেইই, বিশুদ্ধ নাট্যশিল্প বলতে যা বোঝায় সীমান্তিকের দুঃখ সুখের গল্পও তাই। এমন একটি নাটক এই তো সময়ের আগে থাকলে কষ্টবোধ হীনমন্যতা থাকবার কথাই নয়। বরং নাট্যশিল্পেরই বিকাশ ঘটতে বাধ্য।
গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকা দপ্তরে মাননীয় শিব শর্মা এবং নিখিল রঞ্জন দাসের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে দুঃখ সুখের গল্প নাটকটির বিষয় উঠলো। জানতে চাইলাম, “নাটকটার প্রতি এতো অনীহা কেন?”
দুজনেই একই উত্তর দিলেন, “পরিসমাপ্তি বলে কিছু নেই। নাটকটা থেকে কোন সামাজিক উপকারটা সাধিত হবে? অবশ্যই ভালো প্রযোজনা, কোনো ম্যাসেজ নেই।”
ম্যাসেজ কিংবা, স্টেটমেন্ট একটা শিল্পের কতখানি ক্ষতিকারক দিক এঁরা বোঝার চেষ্টাই করলেন না। ম্যাসেজ থাকে গল্পের মধ্যেই। কাবুলিয়ালা গল্পে আলাদা করে রবি ঠাকুরকে বলে দিতে হয়নি, এটি একটি আন্তর্জাতিক মমত্ববোধের ভাবনা থেকে লেখা। টিনের তলোয়ার নাটকে মহান নাট্যকার উৎপল দত্ত কোথাও বলেননি, এটি নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরূদ্ধে বলিষ্ঠ নাট্যলেখ। সততই যদি এই ধরণের সেমিনারিটিক বক্তব্যকে সংলাপে সাজাতেই হয় তাহলেও শিল্পবোধ জরুরী। বেশ কিছু নাটকে সাজালেও গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকা কিংবা, গোঁয়ারে বামাচারী পন্ডিতগণের মনঃপূত হচ্ছে না। তাঁরা চাইছেন সবটাই গোদা গোদা হোক। তাঁদের তুষ্ট করতে গিয়ে একদল নাট্যগুণীজন ভালো ভালো নাটককে কথার খেলায় অস্বাস্থ্যকর করতে লাগলেন, আর এক দল নিজেদের মতো করেই শিল্পের শ্রেষ্ঠত্বের খোঁজে নিরলস কাজ করে যেতে লাগলেন। এমন কয়েকটি যুগান্তকারী প্রযোজনা প্রতিযোগিতার ফাঁপড়ে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়লো অচিরেই। যেমন, চুঁচুড়া সারথীর ‘অরুন্ধতী’, দক্ষিনেশ্বর কোমল গান্ধারের রেন মেকার অনুপ্রাণিত ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’, চুঁচুড়া এষণার ‘হয়তো একদিন’, সংঘমিত্রার ‘বোঝাপড়া”, ইউনিটি মালঞ্চর ‘পথ চলতে চলতে’ প্রমুখ।
এবাদেও, টেক্সট পছন্দ না হলেই ভালো প্রযোজনাকেও বাতিলের ঘরে ফেলে দিতেন অনায়াসে। এমনই একটি প্রযোজনা, ইউনিটি মালঞ্চর ‘দানো’। নিখিল রঞ্জন দাস দানোকে প্রতিযোগিতার মঞ্চে পেলেই এক ধাক্কায় তলায় নামিয়ে দিতেন। অথচ, একই নাটক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কমবেশি এক থেকে তিনের ঘরে থাকছে।
নিখিলদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “দানোর ভুলটা কোথায়?”
নিখিলদা উত্তর দিলেন, “দানোর মতো গবেট চরিত্রটি কখনোই তার মেধাবী ছেলেকে গুছিয়ে বলতে পারে না, আমি তো বোকা। গায়ে আমার অসুরের শক্তি। তুই মারিস আমার মাথায়। তখনই সব তালগোল পেকে যায়।”
মেনে নিয়েও বলেছিলাম, “বেশ, আপনি কি জানেন পেটে ফাইভ পার্সেন্ট অ্যালকোহল গেলে কিংবা অ্যালকোহলের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বমি করবার পর ঘুমিয়ে পড়লে, সমস্ত শিরা উপশিরা এতোটাই নির্জীব হয়ে পড়ে, সে স্বপ্ন দেখতে পারে না।”
একটু অবাকই হলেন, “কোন নাটকটার কথা বলতে চাইছো? এমন নাটক হলে অবশ্যই তাকেও বাতিল করবো।”
হেসে ফেললাম, “আপনারই প্রিয় নাটক এই তো সময়ের একটি দৃশ্য। সুমিত যেখানে ব্রেশটএর সাথে গুছিয়ে সংলাপ চালাচালি করে। অথচ, যেখানেই এই তো সময় প্রযোজনাটি প্রতিযোগিতায় গেছে, আপনি থাকলে চোখ বুঁজে প্রথম স্থানে রেখেছেন।”
রেগে গেছিলেন সেদিন, “তার মানে তুমি না বুঝেই এ্যালিয়েনেশন মেকিং করেছো। ওটা একটি বিশেষ মূহুর্ত যা, রিয়েলিটির সাথে না গেলেও নাট্যমানকেই সমৃদ্ধ করে।”
তর্ক থামালাম না, “বেশ, মেনে নিলাম ওটা এ্যালিয়েনেশন। চায়ের দোকানি ভোগরাজের ধাক্কায় নেশাগ্রস্ত সুমিতের যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় তখনই সে ঘোরের মধ্যে বলে ওঠে- সুরঞ্জনদা..ব্রেশট! ভোগরাজ জানতে চায়, সুমিত কি স্বপ্ন দেখছিলো।
চোখ কচলাতে কচলাতে সুমিত উত্তর দেয়, সে সুরঞ্জনের মধ্যে ব্রেশটকে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো। এটা তো রিয়েলিটি?”
নিখিলদা উত্তেজিত, “অবশ্যই রিয়েলিটি।”
প্যাঁচে ফেলবার জন্য আমিও বললাম, ‘স্বপ্নের বিষয় যদি এ্যালিয়েনেশন হয় তাহলে স্বপ্নটি শেষ হতেই দৃশ্যান্তর ঘটানো উচিত ছিলো। তা না করে জুড়ে দেওয়া হলো রিয়েলিটির সঙ্গে। এটা কি দর্শককে বিভ্রান্ত করা হলো না?”
নিখিলদা হাসলেন,”ওইটুকু মেনে নেওয়া যায়।”
মোক্ষম প্রশ্নটা ছাড়লাম, “তাহলে দানোর ওই সংলাপটুকু মেনে নিতে আপত্তি কোথায়? প্রযোজনা তো অসাধারণ।”
নিখিলদা এবার কড়া গলায় বললেন, “টেক্সট বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠলে সে নাটক সুপ্রযোজনা হলেও তাকে ক্রস করবোই।”
আমিও গলা বাড়ালাম, “তার মানে দানো একটি প্রতিক্রিয়াশীল নাটক, তাই তো?”
নিখিলদাও ভালোই জানতেন দানো কোনো ভাবেই সমাজবিমুখ বিষয় নয়। ইউনিটি মালঞ্চর সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ব্যাক্তিগত বিরোধের উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভয়াভহ সিদ্ধান্ত। যা কিনা নাট্য প্রগতিরই ক্ষতি।
তার বড় প্রমাণ, সংঘমিত্রার প্রতিযোগিতা উৎসবে দানোকে কেন্দ্র করে নিখিল রঞ্জন দাস এবং, আর এক প্রখ্যাত নাট্য ব্যাক্তিত্ব রবীন্দ্র ভট্রাচার্য্যর তিতিবিরক্ত কূটকচালি। দুজনেই গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য। রবীনদার হাতে দানো প্রথম হয়ে বসে আছে, নিখিলদার হাতে ষষ্ট স্থান। দুজনেই দুজনার সিদ্ধান্তে শালপ্রাংশুসম অটল। এমনই অবস্থা, নিখিলদা আমায় আর দলের আর এক মাথা বুড়োকে বলেই বসলেন, “আমি ভাই ফলাফলে স্বাক্ষর করতে পারবো না। রবীনদা যা ভালো বোঝেন করুন।”
প্রমাদ গুণলাম! নিখিলদার হাতে পায়ে ধরলাম। তাতেও তাঁর একই গোঁ। অবশেষে মাথা নোয়ালেন রবীন্দ্র ভট্রাচার্য্যর মতো শান্ত স্থিতধী মানুষটি।
ফলস্বরূপ,দানোর স্থান ষষ্ঠ। সংঘমিত্রার প্রতিযোগিতার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন বড় বড় প্রতিযোগিতার আসরে যে নাটকটি প্রথম নয়তো দ্বিতীয়র নিচে নামেইনি, তার এমন জীর্ণ দশা দেখে আমরাই মুখ লুকোনোর জায়গা পাই না, দেবাশিস বাবলুদের মানসিক অবস্থা কি হতে পারে সহজেই অনুমেয়।
রাগে দুঃখে যন্ত্রণায় মাথা ঠিক রাখতে না পেরে, পুরস্কার বিতরণের দিন হাইন্ডমার্স রঙ্গমঞ্চের সদর দরজা পেরিয়েই শংসাপত্রটি ছিঁড়ে, রাস্তার একপাশে ফেলে, নীরব প্রতিবাদটি জানিয়ে দিলো ইউনিটিরই নিরলস সহযোদ্ধা পিকলু দাম। পিকলুর এমন আচরণে আমরাও ক্ষুন্ন হলাম।
এরপর, অবাঞ্ছিত ভুল বোঝাবুঝির ঠ্যালায় দীর্ঘকাল ইউনিটি মালঞ্চ এবং সংঘমিত্রার সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগই ছিলো না। পথে ঘাটে দেখা হলেও, যে যার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতাম। বলাবাহুল্য, এমন একটি ঘৃণিত রেষারেষির খেলায় এক নাগাড়ে দুপক্ষকেই ইন্ধন যোগাতে থাকলেন মাননীয় নিখিল রঞ্জন দাস এবং,শিব শর্মা স্বয়ং। আমাদের পক্ষে নিখিলদা, ইউনিটির যোগানদার শিবদা। অথচ, দুই মহান ব্যক্তির গলাগলিতে কোনও গোলোযোগই নেই। দিনের পর দিন দুটি দলই অকারণ মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে থাকলাম কর্কট রোগাক্রান্তের মতো।
শেষমেশ বুড়ো আমি বাচ্চুদা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, আয়োজন যদি করতেই হয় উৎসবের আয়োজন করবো। প্রতিযোগিতা যদি করতেই হয়, গোঁয়ারে বামাচারী বিচারক নয়, হাতে কলমে যারা প্রতিনিয়ত মঞ্চে কাজ করছেন, তাদেরকেই আমন্ত্রণ জানাবো। যদি ভুলও করেন, উদ্দেশ্য প্রণোদিত হীনতা দেখাবেন না। এও সিদ্ধান্ত নিলাম, ইউনিটি মালঞ্চ আমাদের চলার পথে শ্রেষ্ঠতম সাথী, সহযোদ্ধা। কিছুতেই লাভের গুড় পিঁপড়েকে খেতে দেবো না। দ্রুত বিবাদ মিটিয়ে ফেলাটাই জরুরি । বলাবাহুল্য, দলের তিন মাথাই এক বছরের মধ্যে ইউনিটি মালঞ্চর সাথে দূরত্ব মিটিয়ে একত্রে অনেক ঐতিহাসিক কাজ উপহার দিয়েছি দর্শকদের। সে বন্ধুত্ব আজও অটুট। শিবদা নিখিলদা তাঁদের নশ্বর শরীর ত্যাগ করেছেন অনেক আগেই। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও বলছি, রেখে গেছেন এমনতর অনেক অবৈজ্ঞানিক কীর্তি যা ভবিষ্যতের খারাপ দিনের সুত্রপাত বললে কম বলা হবে না নিশ্চয়ই
এমন ঘটনা বাংলা জুড়ে আকচার ঘটতে থাকাতে ভালো ভালো দলগুলো প্রতিযোগিতার প্রতি অনীহা দেখাতে শুরু করলো। অথচ, প্রতিযোগিতা ব্যতিরেকে উপায়ও নেই। এমনতর অস্বাস্থ্যকর অভিজ্ঞতার ফলে শীতের প্রতিযোগিতার আসরও অনেকটাই কমে গিয়ে নাট্যোৎসবগুলি ততদিনে বাংলার আকাশে বাতাসে মাঠে ময়দানে মৃদু আবহে বহমান। এতকাল সবটাই ঠুকরে ঠুকরে চললেও চলছিলো। দু’হাজার সালের পর থেকেই দ্রুত পাল্টাতে থাকলো থিয়েটারের অর্থনীতি।
প্রতিযোগিতার আসর কমে এলেও অংশগ্রহণ করতে হবেই। উৎসবগুলি থেকে ডাক আসছে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত নাটকগুলির। পাশাপাশি দেয় অর্থেও দলের ঘরে জমা কিছুই থাকছে না। ইউনিটি মালঞ্চ এবং, গোবরডাঙা নকসার পথেই বাধ্য হয়ে বেশিরভাগ দল ঝাঁপিয়ে পড়লো কেন্দ্রীয় সরকারি অনুদান সংগ্রহের প্রয়োজনে। স্যালারি গ্র্যান্ট, প্রোডাকশন গ্র্যান্ট, উৎসব গ্র্যান্ট, দলগুলোর ঘরে ঢুকতেই অর্থ ভান্ডারটিও মজবুত হয়ে উঠলো। এতোদিন প্রবল কষ্টে দলগুলো চলেছে। ডানচি বাবুর পকেটে রেস্তো এলে যেমন পায়রা ওড়াবার স্বাদ হয় তেমনি, ভারতের বাজারে টাটাসুমো, স্করপিও, বোলেরোর মতো ফ্যামিলিকারগুলো ভ্রমর গুঞ্জনের আওয়াজ তুলতেই দলও চাইলো এবার একটু আয়েশে বিলাশেই বা নড়াচড়া করি না কেন! তিনটে গাড়ি টপকে মেদিনীপুর, বর্ধমান, দুর্গাপুরে প্রথম শো করেও শুকনো গোবরপানা মুখটি নিয়ে অধিক রাতে বাড়ি ফেরা নয়তো, পরেরদিন কাকভোরে। পেটের গোলমাল, চোখে ঘুম নেই, খিঁচড়ে থাকা মেজাজ, কারণে অকারণে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, হাতাপাই, অফিস বসের চোখ রাঙানি, মিলেমিশে চল্লিশটা বছরের বেশি সময় তো কাটানো হলো! নাট্য আন্দোলনও হলো! কোলকাতার প্রতিষ্ঠিত দলগুলো সুখে বিলাসে ভারত ঘুরে বেড়ায়। আমরাই বা কি এমন অন্যায় করলাম?
ব্যস, গতিপথে মোচড়! একটু একটু করে রাবণের পাল নির্মিত অসাধারণ গ্রাফিক্স প্রযোজনার বদলে দুজন লাইটম্যান সমেত মোট আটজনের প্রযোজনা হাজির। মোট দশজন। চলতি ভাষায় যার নাম, টাটাসুমো প্রযোজনা। সুখের জার্নি হলো শুরু। কষ্ট করে বাড়ি ফেরার দিনের হলো অবসান। দুর্গাপুর থেকে শো করেও রাত বারোটার মধ্যে বাড়ি ফেরা যাচ্ছে সহজেই। অফিস বসের ধাতানিও নেই। ভারী ভারী লাটবহর নিয়ে, হাওড়া স্টেশনে নামা মাত্রই দৌড়ঝাঁপ করে বারো নম্বর স্টেশনে গিয়ে, হাঁফাতে হাঁফাতে মেদিনীপুর লোকাল ধরবার দিন শেষ। হওয়াটাই স্বাভাবিক, দরকারও ছিলো। দর্শন, বোধ, সত্তা, মিলেঝুলে এমনই খিচুড়ি পাকালো যে, ভাবতে বাধ্য হলাম, কষ্ট করবো আমরা আর, নীল সোফাসেটে বসে জ্ঞান দেবেন ইনি তিনি।
এরজন্য থিয়েটার দলের এতকালের চলন কোনোভাবেই দায়ী নয়। দায়ী শুধুমাত্র দেশীয় অর্থনীতির নাভিশ্বাস তুলে দেওয়া সিদ্ধান্ত এবং বামপন্থার খোলসে মোড়া ক্ষমতাবান কৃষ্টিমানদের নাট্য প্রমোটারির বাজার দখলের বিষাক্ত হিসহিসানি। বিজ্ঞানগত ভাবে সূদুরপ্রসারী ভাবনার শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ কিংবা, আগামী দিনের কার্যকারীতা সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা তো ছিলই না উল্টে, সরকারে রয়েছি, যা খুশি তাই করবো, এমনই এক উন্মত্ত চিন্তাধারার পৃষ্টপোষক হয়ে উঠেছিলেন। সত্তরের রোমান্সে ভরপুর বিপ্লব বিলাসিতায় ভেসে যাওয়া দলগুলো, যে স্বপ্ন নিয়ে চে গ্যেভারার মতন মাঠ ময়দান কাঁপালো এতকাল, বামপন্থার মধ্যেই আশার ঘর বেঁধে তরী নামিয়ে ভেসেছিলো উত্তাল নাট্যসাগরে। বিশ্ব তথা বাংলা জুড়ে পন্থার করোটিসার দেখতে দেখতে তিতিবিরক্ত হয়েই, থিয়েটার বাঁচাতে তারাও চলার পথ পরিবর্তন করতে লাগলো একমাত্র থিয়েটারেই শেষ নিঃশ্বাস ছাড়বে বলে। তাতেও কৃষ্টিধারী বাম বাবুদের টনক নড়েনি। শেষেরও যে শেষ আছে ধর্তব্যের মধ্যেও আনেননি।
অবশেষে এলো পরিবর্তন। চোখের পলক না ফেলতেই আরও দুর্বিসহ অবস্থা! চারপাশে খুনোখুনি, রাহাজানি, কাটমানি, রাজনীতিকদের অশালীন শব্দের বেপরোয়া ব্যবহার, কৃষ্টি সংস্কৃতিকে কুক্ষিগত করা, সবে মিলে নাট্যদলগুলো আরও দিশেহারা! ততদিনে বেশিরভাগ দলগুলোর মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। বিশ্বাস, ভরসা, সবটাই এলোপাথাড়ি ঘূর্ণীর আদল। কোনো কোনো দল সরাসরি নয়া সরকারের পক্ষে, কোনো দল আবার বামপন্থার প্রতি বিরাগী অনুরাগী অভিমানী হয়েও মতাদর্শের পথ পরিবর্তন করতে নারাজ। মোটের উপর দুপক্ষই শুধুমাত্র, থিয়েটারকে চোখের মণির মতো রক্ষা করতে গিয়ে দর্শনহীন কানাগলিতে পা ঢুকিয়ে দিয়েছে চোখ কান বুজে।
নাট্য আকাডেমির পালা বদল হতে না হতেই নতুন নতুন হাতছানির কবলে পড়তে হলো সকলকেই। সাত হাজার টাকা অনুদান বেড়ে এক লপ্তে হলো পঞ্চাশ হাজার! কিভাবে টাকা আসছে না আসছে অত দেখার দরকার নেই। পঞ্চাশ হাজার মানে দলের কাছে স্বর্গ! অর্থ আদর্শের মাথা চিবোয়। এক্ষেত্রে ঘটলো অন্যরকম খেলা! আদর্শ থাক গোপন কুঠুরিতে। টাকাটা পেলে দলগুলোই বাঁচবে। কেউ কেউ সরাসরি সরকারের পক্ষ নিলো, কেউ দুনৌকায় পা দিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখেই দলে অক্সিজেন যোগানোর কাজে নেমে পড়লো।
নয়া সরকার অসম্ভব দুরদৃষ্টি সম্পন্ন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন। বাম জমানায় নাট্য আকাডেমির গঠনই ছিলো মূলত কোলকাতা কেন্দ্রীক। এই নিয়েও কম আন্দোলন হয়নি। চাপে পড়ে, নতুন শতাব্দীর শেষের দিকে শহরতলি থেকে বিজয় ভট্টাচার্য এবং দেবাশিস সরকারকে আকাডেমির সদস্য পদ দিয়ে খানিকটা উদার হবার চেষ্টা করেছিলেন। নতুন সরকার দিলেন মোড় ঘুরিয়ে। সারা বাংলায় ছড়িয়ে দিলেন নাট্য আকাডেমির গঠনগত প্রসার। উদার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বাম অবাম দুপক্ষই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালাম। আমাদেরই সহমর্মি সহযোদ্ধারা সদস্য পদ পেলে আখেড়ে বাংলা ছোট নাটকেরই মঙ্গল। সফল অসফল প্রত্যেকটি নাট্যদলই উল্লসিত। এরপরেও ঘটতে লাগলো ঘৃণ্যতম নাট্য প্রমোটারির খেলা। দুটি উপমা দিলে খানিকটা বোধগম্য হবে পাঠকের।
সময়কাল দু’হাজার চোদ্দ। গয়েশপুর সংলাপে কাজ করছি। ‘এই তো বেঁচে আছি’, ‘এই আমি এই অন্ধকার’ দুটি প্রযোজনাই বাংলার নাট্যমঞ্চে ব্যপক সারা ফেলেছে। সংলাপের ঘর থেকে রিহার্সাল দিয়ে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎই ছোট্ট মোবাইল রিঙরিঙ করে উঠলো।
ওপারে গলা, “আপনি কি শান্তনু মজুমদার বলছেন?”
“হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?”
“আমি বেলঘরিয়া নিমতা সংঘটনীর সদস্য বলছি। আমরা এবারের প্রতিযোগিতায় আপনার দলকে পেতে চাই।”
যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হলাম অংশগ্রহণ করতে পারবো বলে নয়, যৌবনের শুরুর দিনগুলো থেকে টানা দশ বছরেরও বেশি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। মাঝে অনেকগুলো বছরের ফারাকে তারাও ডাকেনি, আমারও অংশগ্রহণ করা হয়নি। দুএকটা কথা চালচালির পর কথাবার্তা পাকাও হলো।
ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আবার ফোন, “হ্যালো, নিমতা সংঘটনী… থেকে বলছি, আপনি বা আপনার দল কি নাট্যস্বজনের সঙ্গে যুক্ত?”
অবাকই হলাম, “না! কেন?”
ওপারের গলায় অনুনয়ের সাথে হিমধরা সিদ্ধান্তটি ভেসে এলো, “দুঃখিত দাদা, তাহলে নিতে পারবো না। নাট্যস্বজনের সাথে যুক্ত দলগুলোকেই আমরা অন্তর্ভুক্ত করছি।”
বুঝতে পারলাম, আবার নাট্যপ্রমোটারির বিষাক্ত খেলা শুরু হয়ে গেছে। এককালে ঘটতো বুদ্ধিদীপ্ত চতুর পথে, একালে ঘটছে গা জোয়ারি পথে। সেটা যে আরও ক্ষতিকারক, মূহুর্তে অনুভবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভয় ছড়িয়ে পড়লো।
দুদিন পর আবার তাদের ফোন। এবার আবদার, “দাদা, একটা অনুরোধ করছি, দয়া করে নাট্যস্বজনের সদস্য হয়ে যান। তাহলেই নিতে পারবো। প্লিজ দাদা।”
চির রাগী মাথাটিতে রক্ত চড়ে গেলো টগবগিয়ে, “যা বলে ফেলেছেন, বলেছেন। খবরদার এসব নিয়ে অনুরোধ করবেন না। বামপন্থী হলেও আমার শিল্পটি কোনোদিন কারোর তাবেদারী করেনি, এবারেও করবে না।”
ওপারের গলা নামলো বটে, হতাশার স্বর ঝরঝরিয়ে উঠেছে,” সবটাই বুঝতে পারছি। আমাদেরও উপায় নেই। উৎসবের বহুল আয়ে সমতা আনতে অনুদানের জন্য আপিল করেছিলাম রাজ্য সরকারের দপ্তরে। পঞ্চাশ হাজার টাকা পেলাম ঠিকই। শর্ত ছিল, নাট্য স্বজনের সদস্য দলকে নিতে হবে। নিতে গিয়ে কেলেঙ্কারি! একটা দলও প্রতিষ্ঠিত নয়। সেকথা একজন তৃণমূল নাট্যবিদকে বলাতে খেঁচিয়ে উঠলো, – অপ্রতিষ্ঠিত দলগুলোর জন্যই তো সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে তারা বেশি বেশি শো পায়।”
যথেষ্ট মার্জিত ভাবেই বললাম, “সরকার বাহাদুর তো সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সব সময় সেরার সেরা দলগুলোই বা কেন প্রাধান্য পাবে?”
ওপারে করুণ গলা, “সবই ঠিক আছে দাদা, যে কটা নাটক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার বেশিরভাগটাই দেখেছি। একটাও পাতে দেবার যোগ্য নয়। আগামী বছর হয়তো দর্শকই পাবো না।”
আশ্বস্ত করলাম, “আগামী বছর ন্বজন সুজনের ফাঁস ছাড়াতে পারলে ডাকবেন। অবশ্যই যাবো।”
বলাবাহুল্য পরের বছর ভদ্রলোক আবার ফোনে, “গুলি মারি স্বজনের। না ইউনিটি মালঞ্চ, না আরোহী, না আপনি, কেউই নেই। এবছর নিজেদের মতো আয়োজন করেছি। আসতেই হবে।”
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটলো রসুলপুর বিদ্রোহী সংঘের কর্ণধার বর্ধনদার ফোনে, “দাদা, প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে বাধ্য হলাম।”
গত এক বছর ধরে দমবন্ধ পরিবেশ দেখেই বুঝতে পারলাম এখানেও কিছু ঘটেছে।
জানতে চাইলাম, “কি হলো আবার ?”
বর্ধনদার উত্তর, “লোকাল কিছু তৃণমূলের কর্মী এসে বলে যায়, যে কটা নাটক হবে তার পান্ডুলিপিগুলো দিতে হবে। বিশেষ নির্বাচিত নাট্যজন পড়বার পর যদি মনে করেন, এগুলো বামপন্থার পক্ষে, তবে সেগুলোকে বাতিল করতে হবে। আমরা রাজি হইনি।”
জানতে চাইলাম, “কাশিও তো প্রতিযোগিতা করাচ্ছে। ওর অসুবিধা হচ্ছে না?”
বর্ধনদার সহজ স্বীকারোক্তি, “কাশি করিত্কর্মা ছেলে। ব্যালেন্স করেছে নিশ্চয়ই।”
এইভাবেই পনেরর পর থেকে বাকিটুকুও মুখ থুবড়ে পড়লো।
এবার মূল্যায়নে আসা যাক। কোনও রাজনৈতিক দলের কৃষ্টিধারীরা কখনোই উদার মননে নাট্যদলগুলোর যথাযথ পৃষ্টপোষকতা করেননি উল্টে, যখন যেমন প্রয়োজন ব্যবহার করেছেন। আর একদিকে, বেশিরভাগ নাট্যদলগুলোও হাঁড়িকাঠে গলা ঢুকিয়ে নিজেদের বলি দিয়েছেন, থিয়েটারকে বাঁচাতে। দ্বিতীয় দিকটি হলো, ভারতের অর্থনীতি কখনোই সংস্কৃতির আন্তরিক সহায়ক হয়ে ওঠেনি। জীবন যাপনের সব কিছুই নির্ভর করে সুস্থ সবল অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে। দিনের পর দিন মূল সমস্যা থেকে সরে এসে জাতপাত ধর্ম আঞ্চলিকতাবাদ নিয়ে অরাজনৈতিক সাপলুডো খেলা চলেছে। বাম জমানায় দলগুলোকে বিভাজিত করা হয়েছে অমুকদার লবি তমুকদার লবিতে। তৃণমূল জমানায় সরাসরি কে কোন রাজনৈতিক দলের সপক্ষে তার মাপকাঠিতে। জোয়ারের ওপর শরীর ফেলে যে নাটক এতগুলো বছর দাপাদাপি করেছে, ভাটার কালে ডিঙা বাইতে তারাই আজ হিমশিম! এরপরেও, বাম জমানায় উদ্দামতা ছিলো। জাতীয় অর্থনীতি তখনও দিল্লিকা লাড্ডু নয়। চাকরির বাজার হড়েগরে। এ জমানায় জড়িয়ে নেওয়া হয়েছে মায়ার ছলনে। ছোট নাটকের প্রত্যেকটা সুপ্রতিষ্ঠিত দলগুলোর প্রযোজনার অনেকটাই দিশেহারা অবস্থায়। কেউ গ্র্যান্টের টাকায় দেদার খরচ করে প্রযোজনা করছেন, কেউ আবার উৎসবের আয়োজন করতে গিয়ে সেইসব দলগুলোকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, যারা কিনা বিনিময় প্রথায় একটা শো পাবেন। ফলত, নাট্যমানে প্রবল ঘাটতি আজ চোখে পড়বার মতো।
এরপরও ফোনে বিখ্যাত নাট্যদলের কর্ণধাররা কাকুতি মিনতি করেন, “শান্তনুদা, একটা ছোট নাটক দাও করি। বড় নাটকে শোই পাচ্ছি না।”
তখন সহজেই অনুমেয় দলগুলো কতখানি দিশাহীন!
আশার কথাটুকু শুনিয়ে শেষ করবো এই লম্বিত প্রতিবেদন। তা হলো, একমাত্র দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, সেখানে শুধুমাত্র একটি শীতের মরসুমেই নয় নয় করে পঞ্চাশটার বেশি প্রতিযোগিতার আসর বসে। তাদের ভাঁড়ারে সরকারি দান অনুদানের ছিঁটেফোঁটাও নেই। গ্রামের খেটে খাওয়া দিন মজুর আর দু একটা প্রতিপত্তি সম্পন্ন মানুষের দুচার টাকা চাঁদায় এই আয়োজন। মঞ্চের মাপ সত্তর আশির দশকের অন্যান্য জেলার মতোই দৈন্য। রাতে থাকলে মোটা চালের ভাত, পুকুরের মাছ। সুমো, স্করপিওর টাকা দেবার মতো যোগ্যতাও নেই। তারা রাখে না গ্র্যান্টের খবর, তারা জানে না কূটকচালি, তারা জানে শুধু, থিয়েটারেই চরৈবেতি। খরচার অভাবে ভালো ভালো বলিষ্ঠ প্রযোজনাগুলো সেখানে যেতে চায়না। অথচ, প্রত্যেকটি দলই মনে মনে চাইছে, আবার ফিরে আসুক সেইসব হুল্লোড়ে দিন। ফিরে আসুক, আর একটু সুস্থ সুন্দর রূপান্তরে। সেটা একমাত্র পারে একটি শক্তপোক্ত জাতীয় অর্থনীতি। তৎসহ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চেতনা। দুয়ারে প্রকল্পগুলিতে বেচারাদের বেচারা করে রাখা যায়, আখেরে ক্ষতি হয় সর্বাঙ্গীন সুস্থ জীবনের। সুস্থ সংস্কৃতির। নাট্যদলের কর্ণধাররা হাতে কলমে যেদিন বুঝবেন, সরকার মানেই আইনসিদ্ধ রাষ্ট্রীয় গুন্ডামি কিংবা, সরকার অসরকার সব পক্ষই আজ সুস্থ চেতনার সহায়ক, সেদিনই সব কিছুর অবসান হয়ে থিয়েটারে ভোরের এ্যাম্বার কালার জ্বলবেই!