১৮৭৩ সালের কথা বলতে এলাম।
ছাতুবাবুর নাতি শরৎচন্দ্র ঘোষ বিডন স্ট্রিটের এক মাঠে ( আজ সেখানে পোস্ট অফিস) প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বেঙ্গল থিয়েটার’।
এই বছরেই ৩১ শে ডিসেম্বর ৬ নং বিডন স্ট্রিটে জন্ম নিল এক সাধারণ রঙ্গালয়। নাম – গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার। মালিক – বাগবাজারের ধনীর দুলাল নাবালক ভুবনমোহন নিয়োগী। তারপর নানা ঘটনা, আদালত, মামলা-মোকদ্দমা…
মামলা-টামলা নিয়ে ভুবনবাবু একদম পড়েশান হয়ে গেলেন। ১৮৭৭ সালের ২৭ শে জুলাই ভুবনবাবু গিরিশ ঘোষকে এই থিয়েটার লীজে দিয়ে দিলেন। বলতে গেলে গিরিশবাবুই এই থিয়েটারের মালিক হলেন। মালিক হয়েই ‘গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার’ থেকে ‘গ্রেট’ শব্দটি ছেঁটে দিলেন। এরপর নানা কাণ্ড। সেসব অন্য সময়ে বলব।
‘লীলাবতী’ নাটক অভিনয়ের পর ‘ন্যাশানাল থিয়েটার’ খুব উৎসাহের সঙ্গে ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের জন্যে উঠে পড়ে লাগল।
নীলদর্পণের রিহার্সাল কোথায় হবে? জুটে গেল সেই জায়গা। জুটবে নাই বা কেন! কথায় বলে ভালো কাজে ভূতে পয়সা যোগায়। এই কাজে পয়সা, জায়গা দুইই দিলেন ভুবনমোহন নিয়োগী। ইনিই বোধহয় বাংলা থিয়েটারের প্রথম নাবালক প্রোডিউসার। এঁর বাবার নাম ছিল রাজেন্দ্রচন্দ্র নিয়োগী। ঠাকুর্দা রসিকচন্দ্র নিয়োগীর নামে কলকাতার বাগবাজারে গঙ্গার ঘাট। প্রচুর টাকা, প্রচুর জমিদারী। রাজেনবাবু মারা যাবার পর অনেককিছু হয়েছিল। অনেককিছু মধ্যে এই ভুবনবাবু, নাবালক ভুবনবাবু, বুঝতেই পারছেন, কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন। আর এই উৎপাতের টাকা এরকম লোকের হাতে পড়লে যা হয়, তাই হল। শোনা যায় ভুবনবাবু সেই সময়ে দশ টাকার নোট প্রদীপে জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর যা হয়েছিল, সে গল্প অন্যদিন। আজ তাঁর কথা নয়। আজ সেই মানুষটির কথা, যাঁকে আমরা ‘মহাকবি’ বলি।
এই নীলদর্পন হবার সময়ে দলের নাম, টিকিট বিক্রি করা হবে কী হবে না ইত্যাদি নিয়ে বেশ ভালোই ক্যাঁচাল লেগেছিল। আমি সেই ক্যাঁচালের কথাতেও যাব না। কী বললেন? না, মানে, কী জিজ্ঞাসা করলেন? ও, তাহলে আমি কোথায় যাব? আরে মশাই, একটু ধৈর্য ধরে আগে বাড়ুন না। পাইলেও তো পাইতে পারেন বিবিধ বা অমূল্য রতন।
ওই ক্যাঁচালের একটা অঙ্গ ছিল, স্মার্টলি গিরিশবাবুকে দলের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া। তাঁর জায়গায় প্রেসিডেন্ট হলেন একজন অজানা ব্যক্তি, যাঁর নাম বেনীমাধব মিত্র। না এঁর কথাও বলছি না। গিরিশবাবু ন্যাশানাল থিয়েটার কেন ছাড়লেন, কী বলেছিলেন তিনি ( যা বলেছিলেন সেসব ক্ষুরধার কথা) সেসবও বলছি না। গিরিশবাবু কি একা দল ছেড়েছিলেন নাকি? না, না। মোটেই নয়। তাঁর তো কিছু ফলোয়ার বলুন, ভক্ত বলুন, শিষ্য বলুন, বন্ধু বলুন তাঁরাও দল ছেড়েছিলেন। যেমন সুরেশচন্দ্র মিত্র, রাধাগোবিন্দ কর, যোগেন্দ্রনাথ মিত্র, নন্দলাল ঘোষ, মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
এই দেখ, অধৈর্য হবেন না। বসুন, বসুন। দারুণ কিছুই শোনাব। হ্যাঁ, গিরিশবাবুর কথা শোনাব।
দল তো ছেড়ে দিলেন ওঁরা। এবার? গিরিশবাবু তো শিল্পী মানুষ। চুপ করে তো আর বসে থাকতে পারেন না। একটা পালা বাঁধলেন। কাদের জন্যে? সেই সময়ে বাগবাজারে একটা শখের যাত্রা দল হয়েছিল, তাঁদের জন্যে।
সেই পালায় একটি গান তিনি লিখেছিলেন খুব মজা করে, ব্যঙ্গ করে। গানটি মঞ্চে গেয়েছিলেন সুঅভিনেতা এবং সুগায়ক রাধাগোবিন্দ কর। এই রাধাগোবিন্দ কর কে জানেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। ইনিই সেই বিখ্যাত ডাক্তার, যাঁর নামে আজকের আর.জি. কর হাসপাতাল। এঁর বাবার নাম দুর্গাদাস কর। তিনিও ডাক্তার। তাঁর ঢাকার বাড়িতে বসেই তো দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ নাটকের পাণ্ডুলিপি সংশোধন করেছিলেন। এই দেখুন, ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম। যাকগে। আমার আজকের গল্প রাধাগোবিন্দবাবুকে নিয়ে নয়, ওঁর গাওয়া ওই গানটি নিয়ে।
গানটি মন দিয়ে লাইন বাই লাইন এবং শব্দ বাই শব্দ পড়ুন। শব্দের পাশে ১,২… সংখ্যাগুলোও খেয়াল করুন। এ একদম গোয়েন্দা গল্পের মতো ক্লু দিয়ে যাচ্ছি। একেবারে শেষে গিয়ে এই গান নিয়ে কেন বলতে এলাম সেটা বুঝবেন।
গান–
“লুপ্ত বেণী ১ বইছে তেরোধার। ২
তাতে পূর্ণ ৩ অর্দ্ধইন্দু ৪ কিরণ ৫
সিঁদুর মাখা মতির ৬ হার।।
নগ ৭ হতে ধারা ধায়, সরস্বতী ক্ষীণাকায়, ৮
বিবিধ বিগ্রহ ৯ ঘাটের উপর শোভা পায় ;
শিব১০ শম্ভুসুত১১ মহেন্দ্রাদি১২ যদুপতি১৩ অবতাব।
কিম্বা ধর্ম্ম ১৪ ক্ষেত্র ১৫ স্থান,
অলক্ষেতে বিষ্ণু ১৬ করে গান,
অবিনাশী ১৭ মুনি-ঋষি করছে ব’সে ধ্যান;
সবাই মিলে ডেকে বলে, ‘দীনবন্ধু’ ১৮ কর পার।।
কিম্বা বালুময় বেলা, ১৯
পালে পাল ২০ রেতের বেলা ২১
ভুবনমোহন ২২ চরে ২৩ করে গোপালে ২৪ খেলা,
মিছে ক’বে আশা, যত চাষা ২৫
নীলের গোড়ায় ২৬ দিচ্ছে সার ২৭।।
কলঙ্কিত শশী ২৮ হরষে, অমৃত ২৯ বরষে,
জ্ঞান হয় বা দিনের গৌরব এতদিনে খসে,
স্থান মাহাত্ম্যে হাড়ীশুঁড়ি পয়সা দে দেখে বাহার”৩০।
পড়ে ফেললেন তো গানটি? আরো একবার পড়তেই হবে আপনাকে যখন এর পরের লাইনগুলো পড়বেন।
এক একটা শব্দের সঙ্গে ১,২,৩ করে ৩০ পর্যন্ত সংখ্যা রয়েছে, দেখলেন তো। একটু আশ্চর্যও হয়ত হলেন! ভাবলেন এসব আবার কী ব্যাপার রে বাবা! আছে আছে রহস্য আছে। এইবার সেই রহস্য খোলসা করে দিচ্ছি।
১- এর পাশে বেণী পড়েছেন তো? ইনি হচ্ছেন দলের প্রেসিডেন্ট বেণীমাধব মিত্র। প্রথমে এঁর নাম কেউ জানতে পারেনি, তাই নামের আগে দেখুন ‘লুপ্ত’ বিশেষণ ব্যবহার হয়েছে। অন্য দিকে গঙ্গা-যমুনা- সরস্বতী।
২- তেরোধার – ত্রিধারায়
৩,৪,৫,৬,৭ – সবাই অভিনেতা। পূর্ণচন্দ্র মিত্র, অর্দ্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল সুর, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ফিরে দেখলেন বোধহয় গানের লাইনগুলো?
৮- সরস্বতী ক্ষীনকায় – অল্প বিদ্যা বা মূর্খ।
৯- বিগ্রহ – সঙ্গমে দেবমূর্ত্তি বা কুৎসিত গালি।
১০,১২, ১৩, ১৭, ১৯, ২৪, ২৮, ২৯ – সবাই অভিনেতা। যথাক্রমে শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মহেন্দ্রলাল বসু, যদুনাথ ভট্টাচার্য, অবিনাশচন্দ্র কর, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় (বেলবাবু), গোপালচন্দ্র দাস, শশিভূষণ দাস, অমৃতলাল বসু।
সংখ্যার সিরিয়ালটা একটু গুলিয়ে গেল? ভালো কিছু পড়তে হলে, পেতে চাইলে একটু তো কষ্ট করতেই হবে।
১১- কার্ত্তিকচন্দ্র পাল – সম্প্রদায়ের উৎসাহদাতা।
১৪ – ধর্ম্মদাস সুর – স্টেজ ম্যানেজার।
১৫- ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়। অভিনেতা এবং সহকারী স্টেজ ম্যানেজার।
১৬ – বিষ্ণুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – নেপথ্য গায়ক।
১৮ – দীনবন্ধু মিত্র। ( পরিচয় দিতে হবে?)
২০- রাজেন্দ্রনাথ পাল। পাল বংশের কয়েকজন।
২১- রাতের রিহার্সাল।
২২ – ভুবনমোহন নিয়োগী।
২৩ – ভুবনবাবুর কোনো কাজ ছিল না। সেই অর্থে এবং গঙ্গার ঘাটে ভুবনবাবুর বৈঠকখানার কথা।
( এই বৈঠকখানা আর নেই। চক্ররেল হয়ে গেছে)
২৫ – সদগোপ জাতীয় অনেকে এই সম্প্রদায়ে ছিলেন।
২৬ – নীলদর্পণ নাটক।
২৭ – সার-বিষ্ঠা। কাজে নিপুণতা নেই।
৩০ – টিকিট কিনলে প্রবেশাধিকার।
টিকিট বিক্রি করে নাটক হবে কী হবে না, এখান থেকেই তো গণ্ডগোলের সূত্রপাত। নামকরণ নিয়েও ঝামেলা ছিল। মজা বা ব্যঙ্গ কাদের নিয়ে, বোঝা গেল?
লক্ষ্য করে দেখুন, গিরিশবাবু দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে গলা ফুলিয়ে চেঁচামেচি, গালমন্দ করলেন না। প্রতিবাদ করলেন নিজের সৃষ্টি দিয়ে।
অন্যরকমভাবে প্রতিবাদ করলেন বা বলা যায় নিজের ক্ষোভ উগরে দিলেন মহান মহাকবি।