চলচ্চিত্র শিল্পের আবির্ভাবের মুহূর্তে আমাদের রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন এই শিল্পীর অসীম শক্তির ভূমিকা। শিল্প মাধ্যমগুলোর মধ্যে চলচ্চিত্র শিল্প সবচেয়ে শক্তিশালী একটি মাধ্যম। তবে হলিউড টলিউড বলিউড এবং অন্যত্র এই শিল্পকে দোকানদারির বেচা কেনার মধ্যে নিয়ে এসেছিল। আমাদের ভারতবর্ষের মতো দেশে সম্ভবত এই কারণে এই শিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি রোজগার হয়। সরকার তাদের ট্যাক্স আদায় করে।
তবে এই শিল্প নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে শিল্প রসিকরা যেসব উচ্চাঙ্গের শিল্প পরিবেশন করেছিল তার ভূমিকা ও অনস্বীকার্য।
সত্যজিৎ রায়ের মতো অনেকেই স্বীকার করেছেন যে, যেহেতু একটা সিনেমা বানাতে গেলে লক্ষ লক্ষ টাকার দরকার হয়, তাই এখানে এক ধরনের বাণিজ্যের ভূমিকা থেকে যায়। তবে শুধুমাত্র বাণিজ্যের জন্য এই শিল্পে র মধ্যে এসে দাঁড়ান নি অনেক চলচ্চিত্রকার। দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথাও তারা ভেবেছেন। এদের মধ্যে সদ্য প্রয়াত তরুণ মজুমদার একজন।
তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। দেশভাগের পর তাদের পরিবার উত্তরবঙ্গে চলে এসেছিল। কলেজে পড়বার জন্য তরুণবাবুকে কলকাতায় আসতে হয়। রসায়নের ছাত্র ছিলেন তিনি। পারিবারিক টাইটেল ছিল খাসনবিশ।
চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়ে টালিগঞ্জ স্টুডিওতে পা রেখেছিলেন। তখনকার দিনের প্রখ্যাত নায়িকা কানন দেবীর প্রোডাকশন হাউজ শ্রীমতি পিকচার্সে তিনি সহকারী পরিচালকের কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
তাঁর সঙ্গে ছিলেন আর একজন মানুষ তার নাম দিলীপ মুখার্জি।। তরুণবাবু পরবর্তী সময় দিলীপ মুখার্জির এবং শচীন অধিকারীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাত্রীক নামে একটা সংস্থার জন্ম দিয়েছিলেন। যাত্রীকের ব্যানারে অনেকগুলো ছবি তারা পরিচালনা করেছিলেন।
তবে শুরুটা হয়েছিল আশ্চর্য রকম ভাবে।
শ্রীমতি পিকচার্স এর ব্যানারে হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালনায় সেই সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত গল্প নিয়ে শুটিং হচ্ছিল। ছবির নাম রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত। প্রধান ভূমিকায় ছিলেন উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন। পঞ্চাশের দশকে এই ছবিটি দর্শক মনোরঞ্জনে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল।
এই ছবির শুটিং হচ্ছিল বীরভূমের কোন একটি গ্রামে। দিনের আলো যখন পড়ে এলো, শুটিং এর কাজ বন্ধ। তরুণবাবু গ্রামের এক প্রান্তে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দিগন্ত রেখার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দূরে গরুর গাড়ির মিছিল দেখছিলেন। পড়ন্ত লাল সূর্যের লালিমায় আকাশ তখন রক্তিম। গরুর গাড়িগুলোকে সিলুয়েটের মতো দেখাচ্ছিল। শিল্পীর চোখ দিয়ে তরুণবাবু সেই দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা শব্দ। অপূর্ব। এইরকম একটা দৃশ্য যদি ক্যামেরা দিয়ে ধরা যেত!
তিনি আক্ষেপ করছিলেন। মনের আবেগ ব্যাকুলতা অন্য কাউকে প্রকাশ করতে পারছিলেন না। কিন্তু তিনি তখন জানতেন না যে, তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই ছবির নায়ক উত্তমকুমার।
উত্তমবাবু একটা হাত রাখলেন তরুণবাবুর কাঁধে। তারপর বললেন, তোর তো ফিল্মেটিক সেন্স বেশ গভীর। তুই একটা সিনেমা পরিচালনা কর।
তরুণবাবু বললেন, আপনি ক্ষেপেছেন? আমার মতন এক অর্বাচীনকে কে ফাইনান্স করবে?
উত্তমকুমার বললেন, যদি তোর সিনেমাতে আমি আর রমা অভিনয় করি, তাহলে নিশ্চয়ই তোকে অনেকেই টাকা নিয়ে এগিয়ে আসবে।
তবুও তরুণবাবুর দ্বিধা কাটছিল না। তিনি কি পারবেন? এও কি সম্ভব? কিরকম ছবি বানাবেন? সেই গল্প যদি প্রডিউসার এর পছন্দ না হয়! আজেবাজে সস্তা হালকা রুচির কাজ তিনি করতে পারবেন না। জন রুচির কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করতে পারবেন না।
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে জেগে উঠলো একটা গল্প। কিছুদিন আগে দেখা হলিউডের ছবির গল্প। রোমান হলিডে। সেই গল্পের আদলে তিনি লিখে ফেললেন একেবারে বাংলার জন্য, বাঙালি মননের গ্রহণযোগ্য একটা প্রেমের গল্প। বড়লোক বাবার আদুরে রগ চটা মেয়ে, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। কারণ তার বাবা তার বিয়ের জন্য যে পাত্রকে নির্বাচন করেছে ন, সেটা তার পছন্দ নয়।
এই ধনী পরিবারের মেয়েটি যে কখনো দারিদ্র দুঃখ যন্ত্রণা দেখেনি, কঠিন বাস্তবের ইটকাট পাথরের পৃথিবীতে পা রাখেনি, সেই মেয়েটা এবার এসে পড়ল জ্বলন্ত আগুনের মতো একটা পৃথিবীতে। ঘটনাচক্রে পরিচয় হলো এক সুদর্শন তরুণের সঙ্গে। সেই তরুণটি তখন ভাগ্যচক্রে পড়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল। সাংবাদিকের পেশাতে সে নিজেকে কোনোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছিল না।
ষাটের দশকে শুরুতে এই গল্প নিয়ে চিত্রনাট্য লেখা হলো। যিনি লিখলেন তার নাম নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক। এর আগেও অনেক সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। নাম ডাক রয়েছে তাঁর।
শুরু হয়ে গেল শুটিংয়ের কাজ। ছবির নাম রাখা হলো চাওয়া পাওয়া।
এই ছবির জন্য উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন কোনোরকম পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। তরুণ পরিচালক তরুণ মজুমদারকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তাঁদের এই উদ্যোগ ইতিহাস কি মনে রেখেছে?
উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন সেই সময় খ্যাতির মধ্য গগনে। তাঁদের জুটির একেকটি সিনেমা মুক্তি পেলে প্রতিটি সিনেমা হলে হাউস ফুল বোর্ড ঝুলানো থাকতো। উত্তম কুমার পরবর্তী কালে এইভাবে আরো অনেক পরিচালককে তুলে এনেছে। গোপনে অনেক গরিব টেকনিশিয়ানদের সাহায্য করতেন।
উত্তম সুচিত্রার সেলুলয়েড প্রেম কাব্যের কাহিনী গুলোর মধ্যে এই ছবিটি একেবারেই ব্যতিক্রম। প্রথম ছবি পরিচালনা করতে এসে তরুণ মজুমদার প্রমাণ করে ছিলেন তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। চাওয়া পাওয়া কলকাতার হল গুলোতে টানা চার মাস হাউসফুল দিয়েছিল।
তারপর থেকে তরুণবাবুকে আর পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়নি। যাত্রিক গোষ্ঠী পরের যে ছবিটি উপহার দিলেন, সেই ছবির নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ মুখার্জি। ছবির নাম কাঁচের স্বর্গ। এই ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার অর্জন করেছিল।