অনু নাটক | বসন্ত এসে গেছে | অসীম দাস

চরিত্র – অপর্ণা, রূপেশ, প্রতীক

সাজানো ডাইনিং স্পেস, সিঁড়ি দিয়ে দোতলার ব্যালকনি দেখা যায়। রঙিন পাতাবাহার গাছ সহ হরেক বনসাই টবে। ২৭/২৮ বছর বয়সী স্বামী মারা গেছেন, দেখে বোঝার উপায় নেই , অপর্ণার পরনে হাউজ কোট।

প্রচন্ড গতিতে আসা একটি চার চাকা গাড়ি এসে অপর্ণার বাড়ির কাছে এসে থামে। হর্ণ বাজায়, দু’বার বাজানোর পর ব্যালকনির কাছে এসে অপর্ণা দাঁড়ায়)

অপর্ণা- কে? কে হর্ণ বাজাচ্ছে এভাবে? (দূর থেকে)

রূপেশ- আমি, আমি —

অপর্ণা- আমি কে?

রূপেশ- (গাড়ির গেট খোলার শব্দ) আমি রূপেশ! চিনতে পারছো না? একটা বছরে কতটুকু আর পালটেছি আমি? (চেনা তবু অচেনা গানের আবহ)

অপর্ণা- ও রূপেশবাবু; আপনি! কি মনে করে এলেন এই একটা বছর পর? আপনাকে তো আমি…

রূপেশ- ভেতরে আসতে বলবে না আজ?

অপর্ণা- ভেতরে? আচ্ছা আসুন.. (লোহার গেট খোলার শব্দ) ভেতরে কেন যে আসতে চান… (অনেকটা স্বগত)

রূপেশ- মনের ভেতরেই তো রাখতে চেয়েছিলাম, যাকগে। কেমন আছো? দেখে তো তোমাকে বেশ সুখেই আছো মনে হচ্ছে !

অপর্ণা- আমি তো মনের ভেতর থাকতে চাইনি ; কালও না, আজও না। তবে কেন যে —

রূপেশ- একটা বছর পাড় হয়ে গেল,অথচ এতটুকু বদলাও নি!

অপর্ণা- আর বদলাতে চাইও না (অভিমান)

রূপেশ- আমি কিন্তু বদলাইনি দেখো (মিউজিক)
গত দশ বছর ধরে আমি একই ভাবে কিন্তু তোমাকে চেয়ে এসেছি, বরং তুমিই …

অপর্ণা- আমি কিন্তু এসব কথা আর শুনতে চাই না। আমাদের যা সম্পর্ক ছিল তা সবটাই এখন অতীত। কেন আমার অতীতকে টেনে আনতে চাইছেন রূপেশবাবু ?

(হোঁচট খাওয়ার মত)

রূপেশ- যতই তুমি রাগ দেখাও না কেন অপর্ণা, তুমি কি ভুলতে পেরেছো অতীত?

অপর্ণা- হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি সব ভুলে গেছি —

রূপেশ- না তুমি ভুলতে পারোনি। আর তুমি ভুলতে চাইলেও আমি তোমায় ভুলতে দিতে পারি না অপর্ণা।
(কাছে গিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে)
বসতেও বলবে না?

অপর্ণা- (রাশ) না, বসতে বলবো না। কেন প্রতিবছর এসে একই কথা বলেন বলুন তো? গত পাঁচ বছরে একবার একটা দিন এসে সারাটা বছর ধরে জিইয়ে রাখা স্বপ্ন, কেন নষ্ট করে দেন? কেন তছনছ করে দেন? কি লাভ পান আপনি? (কান্না) আপনি বদলালেও আমি বদলাতে পারবো না। আর আমি কোনদিন ক্ষমাও করতে পারবো না তোমাকে– (রাগে দুঃখে কান্নায় ভেঙে পড়ে অপর্ণা, চেয়ারে বসে)

(স্যাড মিউজিক)

রূপেশ- ক্ষমা কি আমি নিজেকে করতে পেরেছি ? না পারবো অপর্ণা?

(মেঘ ডাকার শব্দ বাইরে, রূপেশ কাছে গিয়ে বসে)

তুমি কি আজও তোমার স্বামীর মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করো অপর্ণা?

(দূরে আকাশে যেন কোথাও বাজ পড়ল, (বিদ্যুৎ চমকানোর আলো খেলে গেল অপর্ণার শরীরে)

অপর্ণা – হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই আমার জীবনটা শেষ করেছো — তুমি —

রূপেশ- অপর্ণা —

অপর্ণা- নিজের হাতে আমি সেদিন নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছি, শেষ করেছি নিজেকে। মনে করো রূপ মনে করো, সেদিনটা ছিল দোলপূর্ণিমার সকাল। তুমি সেদিন কোনোরকম ফোন না করেই…

(দৃশ্য বদলে যাবে অপর্ণার বেডরুম অনেক বছর আগের ।
স্মৃতি মনে করার মিউজিক, এবার স্কুটারের হর্ণ । অপর্ণা শাড়ি পড়া, রূপেশের পরনে কোট টাই)
(দূর থেকে)

(প্রতীক মোবাইলে কথা বলছিল অফিসের কারোর সাথে। হাসি ঠাট্টায় খোশমেজাজে ছিল)

প্রতীক – আরে হ্যারে বাবা, বড় সাহেব দেখলি তো কেমন আড় চোখে তাকাচ্ছিল তোর দিকে। তুই কি করছিস, কতবার রুমকির দিকে তাকিয়েছিস। আমাকে তো ডেকে এসবই জানতে চাইছিল। জেলাসিরে বাবা জেলাসি, হ্যা জানি তো, হ্যা তুই ঠিক বলেছিস তো, তাই ভাবছি বাগচিসাহেব এখন অফিসে তাড়াতাড়ি আসেন কেন! Decline in age. বয়স কালে বুদ্ধি নাশ! ছাড়, জাল দেখা হচ্ছ।

(দরজায় কলিং বেল… এবং ডাকতে থাকে নাম ধরে রূপেশ।)

অপর্ণা -(ভেতর থেকে) প্রতীক, দেখো তো কে এলো?

প্রতীক – দেখছি দেখছি (আবার হর্ন) উফ্, কে এই সাত-সকালে, কে এলো বলো তো?

অপর্ণা – আমি কি করে জানবো? দেখই না?

প্রতীক – খুলছিরে বাবা, খুলছি! দাঁড়ান! (দরজা খুললে রূপেশ ঢুকে পড়ে) — আপনি…?

রূপেশ- আমি রূপেশ, নমস্কার। অর্পণা আছে?

প্রতীক- নমস্কা-র…. আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না — (হাসি মুখে)

অপর্ণা- কে এসেছে গো? (বলতে বলতে ভেতর ঘর থেকে ডাইনিং স্পেসে আসে)

প্রতীক- তুমি এসো তো। এসে দেখো, তোমার কেউ চেনা হয়ত, আমি বাথরুমে ঢুকলাম —

অপর্ণা- আমার…! (আবহ সঙ্গীত বেজে ওঠে আমারও পরান যাহা চায়) তুমি….! রূপেশকুমার ভট্টাচারিয়া; এত সকাল সকাল, এসো এসো ভেতরে এসে….

রূপেশ- আমার অর্ণা (জড়িয়ে ধরে)

অপর্ণা- এ কি করছো? ছাড়ো ছাড়ো, আমার হাসব্যান্ড —

রূপেশ- ও সরি সরি। তুমিতো বিবাহিতা… আমি ত ভুলেই গেছি। তা বলে কি আদর —

অপর্ণা- না না রূপ ; প্লিজ ছাড়ো!

রূপেশ- ছাড়িয়ে নাও পারো তো! বিয়ের আগে তো এমন কত আদর করে বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছি তোমায়?

(নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্যাকেট থেকে আবীর নিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রূপেশ কে , আদর করে দুগালে আবীর মাখিয়ে দেয়)

অপর্ণা- আজ তোমায় রং মাখিয়ে ভূত করবো দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। (লুকোচুরির মত দুজনে খেলে)

(আবহ শোনা যায় – খেলবো হোলি রং দেবোনা, পাঁচ সেকেন্ড চলবে; তারপর রোম্যান্টিক মুহূর্তে দেখা যাবে দুজনকে)

রূপেশ – সাহস তো তোমার হাতের মুঠোয় দেখছি! এবার ভয় করছে না?

(এবার রূপেশ জড়িয়ে ধরে অপর্ণাকে)

অপর্ণা- ছাড়ো প্লিজ, ও এসে গেলে…

রূপেশ- আসুক, তোমার আমার প্রেমটা জানুক। কি হবে, I never got you as a wife in my life, সেটা আমার ব্যাড লাক… বাট, লাভার হিসেবে তো পেতেই পারি। আমি কিন্তু তোমাকে আজও একই ভাবে ভালোবাসি… Believe it is true!

(প্রতীক চিরুনি খুঁজতে এসে এসব দেখে ভীষণ রেগে যায়)

প্রতীক- অপর্ণা (ধমক)! এতদূর! এতদূর, ছিঃ! আড়াল থেকে সব কথা আমি শুনেছি তোমাদের। ছিঃ ছিঃ! এতদিন আমি যার সঙ্গে সংসার করেছি, সে কিনা! এই আমার ভালোবাসা! এভাবে আমায় ঠকাতে পারলে?

অপর্ণা- বিশ্বাস করো ও আমার অতীত, যা আমি ভুলে যেতে চেয়েছি (বিচ্ছেদের গানের সুর)

প্রতীক- বিশ্বাস তোমাকে! নিজের চোখে যা দেখলাম, ছিঃ,
(আবহ শোনা যায় – ‘ভেঙ্গে যায় বিশ্বাস,কি কারণ)
পাঁচটা বছর ধরে তোমার মত অবিশ্বাসের সাথে ঘর করেছি! আমাকে তুমি প্রতারণা করেছো। You are such a big liar.
পাঁচটা বছরেও একটা মানুষকে চিনতে পারলাম না! আমি এত ভুল করেছি! এত ভুল…!

অপর্ণা- না,না। বিশ্বাস করো! এসব সত্যি না (কান্না)

প্রতীক- আমাদের সন্তান কি তাহলে একটা ভুলের ফসল! না, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না,i can’t believe you really, ও আমার সন্তান তো! বলো….অপর্ণা….

অপর্ণা- বাবু, আমাদের সন্তান, তুমি ভুল ভাবছো–

প্রতীক- এটাই আমার তাহলে পাওনা ছিল বলো ; নারী তুমি ছলনাময়ী। না, এ ভুলের তো কোনো ক্ষমা হওয়া উচিত নয়; তুমি কি চাও বলো! মুক্তি! Wait to get it, যাও আজ থেকে তুমি মুক্ত ।

(ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় প্রতীক। দরজা খুলে রাস্তার দিকে ছুটতে থাকে, অপর্ণা ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে)

অপর্ণা- দাঁড়াও, দাঁড়াও বিশ্বাস করো, কোথায় যাচ্ছো শোনো… দাঁড়াও…, সামনে গাড়ি আসছে, একটা বিপদ ঘটে যেতে পারে প্রতীক —
আলো এসে ফ্রন্ট স্টেজে জমা হয়। মনে হয় রাস্তা। রাস্তায় সিগনাল সবুজ হতেই স্পিডে গাড়ি বেড়িয়ে যায়, প্রচন্ড গতিতে আলো এপাশ থেকে ওপাশে চলে যায়)
(একটা প্রচন্ড চিৎকার, অ্যাক্সিডেন্ট, গাড়ি ব্রেক করার শব্দ… প্রতীক ছোটে, পেছনে অপর্ণা।)

অপর্ণা- যেও না, গাড়ি আসছে, অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে, যেও না (আবার আগের দৃশ্যে একই পোশাকে ফিরে আসে অপর্ণা রূপেশ)

রূপেশ- আমার একটা ছোট্ট ভুলের জন্য, তোমার জীবনে এত বড় একটা ঝড় এসেছিল সেদিন, তা আমি ফিল করেছি, তাবলে কি আমি শাস্তি পাইনি অপর্ণা? বলো?

অপর্ণা- ছোট্ট একটা ভুল! হ্যা, ছোট্ট একটা ভুল; তোমার কাছে একটা ছোট্ট ভুল, কিন্তু অনেক বড়ো শাস্তি! (বিস্ময়)

রূপেশ- আর কত শাস্তি আমি পাব ! নিজের সর্বসুখ বিসর্জন দিয়ে তোমাকে ভালোবাসতে চেয়ে। আজও আমি তোমার কাছে দু হাত বাড়িয়ে আছি। প্লিজ আমি তোমাদের সমস্ত দায়িত্ব নিতে চাই।

অপর্ণা- তা হয় না রূপেশ, তোমার সমাজ কি মেনে নেবে?

রূপেশ- গত পাঁচ বছর ধরে এই দিনটায় তোমার আর বাবুর দুঃখটাকে ভাগ করে নেব বলে ছুটে আসি, বিশ্বাস করো। সমাজের ভয় থোড়াই পরোয়া করি আমি! তুমি শুধু বন্ধু ভেবে এই হাতটা ধরে… দেখো, প্লিজ!

অপর্ণা- রূপেশ, এত অপমানের পরেও তুমি আমায় ভুলে যাওনি? অবাক হচ্ছি।

রূপেশ- এসো, (ব্যালকনিতে অপর্ণাকে নিয়ে দাঁড় করায়) নিচে দেখো ; পাড়ার বাচ্চারা গলিতে রং নিয়ে কেমন ছুটছে দেখো; তোমার না আমাদের ছেলেটাকে দেখো পিচকারি হাতে ছুটছে, বেলুনে রং ভরে মেয়েটার গায়ে ছুঁড়ে কি অবস্থা করেছে ( আনন্দে চোখ চকচক করে ওঠে)

অপর্ণা- কিন্তু বাবু কি মেনে নেবে? প্রতীকের ছেলে কিন্তু প্রতীকের মত, যদি —

রূপেশ – আজ থেকে বাবু আমারও ছেলে…

অপর্ণা- সত্যি —

রূপেশ- অপর্ণা; দেখো আকাশ জুড়ে এক ঝাঁক সাদা বক ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে, পলাশ ফুলের রঙে কেমন লাল হয়ে গেছে!

(ব্যালকনি থেকে নেমে আসে ডাইনিং রুমে)

তোমার সাড়া মুখে আজ রং দিয়ে রাঙিয়ে দিতে চাই (দুজনের চোখ স্থির হয়ে আসে।কোনো কথা বলতে পারে না কেউ। অপর্ণা স্টেজের ডানদিকে রাখা টবের গাছটাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে চোখের জল ফেলে
পেছনে এসে দাঁড়ায় রূপেশ,কাঁধে হাত রাখে, সবুজ আলো এসে পড়ে।)

(নয়নে জাগিল প্রেম, বসন্ত এসে গেছে)

নমস্কার