অভিমুখ- ১১
[অভিমুখ লেখা শুরু হয়েছিল সিলি পয়েন্ট পোর্টালে। দশটি এপিসোড টানা লেখার পর শেষ হয়েছে সেই ধারাবাহিক, আপাতভাবে। পরবর্তী পর্বগুলো শুরু হচ্ছে অমল আলো জার্নালে। ]
আমতা পরিচয় নামে আমাদের রেজিস্ট্রি হয় ২০০৫ সালে। যদিও তার আগে থেকেই আমরা ‘পরিচয়’ নাম দিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম, কিন্তু ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৫ রেজিষ্ট্রেশানের শর্তানুসারে আমতা নামটি যুক্ত করতে হলো। তাই সেই দিন থেকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের জন্মদিন বলে পালন করি। এখনও পর্যন্ত সর্বমোট ১৬ টা প্রযোজনা হয়েছে। তোমরা তো এসেছো গুরুকূলে। জানোই তো সব। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে জানালেন ঋতুপর্ণা।’
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা বিশ্বাস। তার জীবনের অনেক অংশই আমার জানা। ব্যক্তিগতভাবে আমরা একত্রে মঞ্চাভিনয় করেছি আমারই নির্দেশনায় ‘কন্যা তোর’ নাট্যে। বুঝেছি তার অভিনয়ের শক্তি। মিনার্ভা রেপার্টারির দেবী সর্পমস্তার দ্বিতীয়বার তৈরির সময় তিনিই ছিলেন দেবী। এখন তিনি এলাদিদি থেকে উত্তরা হয়ে সাবিত্রীবাঈ ফুলে বহমান নদীর মতো তার জীবন প্রতিকূল পরিবেশ পেলেই অন্য খাতে বয়ে খুঁজে নেয় নাট্যের নিজস্ব ভাষা এবং পরিসর। স্কুলে স্কুলে, কলেজে কলেজে অভিনয় তাকে প্রসিদ্ধি দিয়েছে। তার কাছ থেকে জানা গেল, গুরুকূলের ভাবনা বলতে মূলত প্রয়োজনের তাগিদে হলেও স্বপ্ন অনেকদিন আগে থেকেই তারা দুজনে দেখেছিলেন। বলা বাহুল্য তারা মানে ঋতুপর্ণা ও তার স্বামী বন্ধু নির্দেশক মিতভাষী শুভেন্দু ভান্ডারি। ঋতুপর্ণা ছোট্ট থেকেই থিয়েটারের পরিবারে বড় হয়েছেন। সেখানকার খুনসুটি, একসঙ্গে থাকা, একান্নবর্তী পরিবারে থেকে যারা আনন্দ পায় তারা বোধহয় সারাজীবন একসঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকে। আর শুভেন্দু ভাবতেন এইরকম ২৪ঘন্টা থিয়েটারের জন্য একটি ক্ষেত্র বা গ্রাম। এই দুই ভাবনার সংঘর্ষ তথা সংশ্লেষেই গুরুকূলের জন্ম। যেখানে ২৪ঘন্টাই থিয়েটারের শিল্পীরা নিযুক্ত থাকবে নিজেদের মত করে। এই সম্পর্কে তাদের প্রথম ধারণা তৈরি হয়েছিল প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী রতন থিয়ামের কাছ থেকে। আবার ২০০২ সালে “কাঠ” নাটকটা দেখতে গিয়ে তারা জানতে পারেন উড়িষ্যায় সুবোধ পট্টনায়কের নাট্যগ্রাম আছে। যদিও তা নিজের চোখে দেখেন ওরা ২০১৩ সালে, স্বপ্নটা আসতে আসতে জোরালো হচ্ছিল। ‘কিন্তু মূলত প্রয়োজন বাধ্য করল গুরুকূল তৈরি করতে। আমাদের গ্রামে রিহার্সালের স্পেস ছিল একটি প্রাইমারি স্কুলঘর। একদম আমাদের ঘর লাগোয়া স্কুলের প্রাঙ্গন, আমরা সাধারণত সেখানেই আমাদের নতুন প্রযোজনা মঞ্চস্থ করতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আত্মীয়, পরিজন, কিছু প্রতিবেশী তাদের আপত্তিতে সেই স্কুলঘরে আমাদের নাট্যচর্চা বন্ধ হয়। এরপর ক্লাবঘর পেলাম, সেখানেও ক্লাবের লোকজনের দুপুরবেলা ঘুমের অসুবিধের জন্য আমাদের নাট্যচর্চার স্থান সরাতে হলো। পাশের গ্রামে শ্মশানের পাশে শরীরচর্চার একটি আঁখড়াতে। যেটার চারপাশ উন্মুক্ত, খোলা আকাশের নীচে, যেখানে মেয়েদের বাথরুমের প্রভূত সমস্যা এবং বিভিন্ন সমস্যার মধ্যেও আমাদের নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে মূলত যে দর্শনে আমরা বিশ্বাসী নই, সেখানে বারংবার বিরোধ তৈরি হচ্ছিল। বাড়িতেও ঠাঁই নেই, অগত্যা এক কিলোমিটার দূরে বর্তমানে গুরুকূলের কাছে সরপোতা গ্রামে ২ কামরার একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। সেখানেই আমাদের রিহার্সাল শুরু হয়, কিন্তু ঘর বলতে ৮/৮ এর দুটো ঘর, জিনিস রাখব কোথায়? বসব কোথায়? কাজ করব কোথায়, কিন্তু মজার ব্যাপার প্রায় ১৫/১৬ জন আমরা এক সঙ্গে সেখানেই দিন রাত এক করে দিতাম, রিহার্সাল করতাম ছাদে, রাস্তার ওপরে যেহেতু তাই রাস্তার দিকে একটা ত্রিপল টাঙিয়ে দিতাম, কিন্তু খোলা আকাশের নীচে গরমকালে সেও এক সমস্যা, শীতকালে আরেকরকম সমস্যা, বর্ষাকালে কাজ বন্ধ। এভাবেই চলছিল।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে খানিক দম নিলেন ঋতুপর্ণা। চোখে যেন তার প্রতিজ্ঞার বহুবর্ণ আলো একত্র হয়ে তখন শরীর বেশ খারাপ। থাবা বসিয়েছে অস্ত্রপ্রচার।
জল খেয়ে সামান্য থেমে বলে চলেন, ‘… তাই সবাই মিলে ঠিক করলাম পাশেই একটি জমি আছে মূলত দীর্ঘদিন আগে সেখানে চাষ হতো, কয়েক বছর ধরে চাষও বন্ধ। যদি মাটি ফেলে উঁচু করে একটা আটচালা করা যায় তাহলে রিহার্সালটা অন্তত করতে পারব। আর গ্রামে ঘুরে ঘুরে যেমন শো করছি, তেমনই না হয় চলুক, সেই ভাবনা থেকে গুরুকূলের আটচালা তৈরি হলো, বাঁশের স্ট্রাকচারের উপরে খড়ের চাল, তার থেকে বেশি ভাবার সামর্থ্যও ছিলনা অর্থনৈতিক কারণেই। সেই সময় আরেকটি ঘটনা ঘটল যার জন্য আজকের এই গুরুকূল। স্থানীয় একটি ক্লাব তাদের কালীপুজোয় আমাদের কাছে বিরাট অঙ্কের চাঁদা চেয়ে বসে, আমাদের কাছে প্রায় অসম্ভব, সেই ক্লাবের মাননীয় সদস্যরা ঐ ভাড়া বাড়িতে এসে হাঙ্গামা করে, আমাদের সঙ্গে বচসা হয়। শুভেন্দু আহত হয় এবং রীতিমত ভয় দেখায় আমাদের ওই নাটকের আটচালা ভেঙে দেবে বলে। ওই ক্লাবে বেশ প্রভাবশালীদের প্রভাব ছিল, গুরুকূলের ওই চালাটা করতেই ৮০,০০০ টাকা, এবং মাটি ফেলতে তার আগে প্রায় ২৫,০০০ টাকা বেড়িয়ে গেছে ততদিনে, একে তো আর্থিক সমস্যা, তায় আবার এরকম ভয়, একবার ভেঙে দিলে আর দ্বিতীয়বার করতে পারবনা। ঘটনাটা সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকে লিখলাম, বহু মানুষের আশ্বাস পেলাম, স্বয়ং মাননীয়া অর্পিতাদি (ঘোষ) আশ্বাস দিলেন। পরেরদিন ঠিক করলাম আমরা আমাদের বিধায়কের কাছে যাব, সেই মতো গেলাম। তিনি দেখা করলেন তাকে স্ববিস্তারে ঘটনা জানালাম, এবং তিনি আমাদের পাশে আছেন জানালেন। আমাদের মনে হলো এত বড় আশ্বাস যখন পেয়েছি, শুধু রিহার্সাল নয়, এখানে এনে নাটকও মানুষকে দেখাতে হবে। এখানকার গ্রামের মানুষের নাট্যচর্চার কেন্দ্র হোক আমাদের এই গুরকূল এই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা।’
এবারে মুখ খোলেন শুভেন্দু। ‘ধীরে ধীরে আমাদের যে স্বপ্ন, আশ্রমিক জীবনের স্বপ্ন, যার কথা আগেই বলেছি, নাট্যচেতনার নাট্যগ্রাম, আমাদের স্বপ্নের সোপানের ভিত, খুব সাধারণ জীবন যাপন, চাহিদা কম। এমন যাপনে দিনের ২৪ ঘন্টার ২৪ ঘন্টাই একসঙ্গে থেকে একটা চর্চার মধ্যে থাকতে পারব, তেমন একটা আশ্রমিক রূপ পাক আমাদের এই নাট্যক্ষেত্র, সেইভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে ডঃ আশিস গোস্বামী নাম দিলেন “গুরুকূল পরিচয়”,। যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০১৭ সালে। বিধায়ক শ্রী সমীরকুমার পাঁজা উদ্বোধন করেন। স্থানটি ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ। তবে ইতিহাস নিয়ে যাদের ঔৎসুক আছে, তাদের মেলার মত অনেক কিছুই রয়েছে এখানে। আমতা স্টেশন থেকে মাত্র ৮কিমি, এবং বাসস্ট্যান্ড থেকে ৭কিমি ভেতরে প্রেম রোডের ধারে এই গুরুকূল। গুরুকূলের চারপাশে ইতিহাসের অনেক সাক্ষী এখনও তার ধ্বংসাবশেষ দুপুরের রোদের মতো সত্য অথচ একলা দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরপূর্বদিকে প্রায় ৫কিমি দূরে রয়েছে প্রাচীন জনপদ মুন্সিরহাট, সেখানে পিএটি (পিপলস্ এ্যালবাম থিয়েটার) নামে একটি নাট্যসংস্থা রয়েছে যার বয়স ৪৮বছর। যদিও এই পরিস্থিতির জন্য ২০০৯ সালের পর আর কোনো প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়নি। তবু আপামর এলাকাবাসীর কাছে নাট্যশিল্পীদের কাছে তার গুরুত্ব অপরিসীম। হাপেজপুরে একটি মাজার রয়েছে যার ঐতিহাসিক গুরুত্বও বেশখানিকটা রয়েছে। পশ্চিমদিকে ৭কিমি দূরে বয়ে চলেছে দামোদর নদ। গুরুকূলের খুব কাছেই কাষ্ঠসাংড়া গ্রামে সিপাহীবেড় আছে যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে যথেষ্ট কিন্তু রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে এখন প্রায় কিছুই বোঝা যায়না। কাস্তে কবি দীনেশ দাসের বাড়ি, রায়গুনাকার ভারতচন্দ্রের বাসস্থানও কিন্তু রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে সেইভাবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ দিকে ৭কিমি দূরে রয়েছে প্রাচীন জনপদ আমতা, যেখানে প্রথম মাটিন রেল চলেছিল। আমতা বন্দর ছিল যোগাযোগের একমাত্র পথ, সেখানে মেলাইবাড়ি মেলাইচন্ডির জন্য বিখ্যাত। আরেকটু দামোদরের ওপারে তাজপুরে মহিষামুড়ি গ্রামে বেশ কিছু টেরাকোটা কাজের মন্দির রয়েছে। এদিকে ঝিখিরার দিকে একটু এগিয়ে গেলে অমরাগোরিতে আছে দধিমাধবের টেরাকোটার মন্দির। হেরিটেজ স্থান বলে যা সংরক্ষিত।
‘যদিও এসব ভাবনা আমাদের গুরুকূল গঠনকালে ছিলনা।’ জানালেন ঋতু। ‘আমাদের যে স্পেসটি ৪কাঠা জায়গা নিয়ে তৈরি যেখানে (২০x২৫) বর্গফুট রিহার্সাল বা পারফর্মেন্স স্পেস, সঙ্গে এ্যাটাচ বাথরুম, ১৩/১২ একটা মেকআপ রুম, সাঙ্গে ৮/৮ এর বাথরুম, ১২/১২ এর একটা ক্যান্টিন, ১২/১০ একটি কম্পিউটার রুম, ১০/৮ একটি লাইব্রেরি, এছাড়া ২কাঠা জায়গায় একটি মুক্তমঞ্চ, ১কাঠার একটি ছোট্ট পুকুর, একটি ওপেন এয়ার মেডিটেশন স্পেস, ৬কাঠার জায়গায় জৈব পদ্ধতিতে চাষের জায়গা। এছাড়াও বাইরে দুটো পাকা বাথরুম, ৫০০ বর্গফুট স্পেসটিতে ৫০ জন দর্শক বসতে পারেন।’ আমি নাটক দেখতে এসে দেখেছিলাম আলোর ব্যবস্থা বিশেষ কিছু নেই। জিজ্ঞেস করতে জানা গেল
বর্তমানে ৫টি ৫০০ ওয়াট হ্যালোজেন ছাড়া সত্যিই আর কিছুই নেই, যদিও ২০টি আলো ছিল, গত ২০১৫ সালের বন্যায় সবকটাই নষ্ট হয়েছে। সাউন্ড সিস্টেমে ১২চ্যানেলের মিক্সার মেশিন, একটি কর্ডলেস মাইক্রোফোন, পাঁচটি ল্যাপেল ইত্যাদি রয়েছে। তবে সাইক্লোরামা নেই, কালো পর্দা দিয়ে চারদিক পুরো ঘিরে দেওয়া যায়,আলাদা করে কার্টেন, উইংসের ব্যবস্থা নেই। শুভেন্দু জানান ‘ আমাদের প্রথম থেকেই স্পষ্ট ধারণা ছিল, আমরা কোনো ভাবেই মঞ্চের ছোট্ট সংস্করণ হিসেবে এই স্পেস করবনা, গ্রাম্য পরিবেশে গ্রাম্য নাট্যের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। হ্যাঁ আলোর প্রয়োজন হলেও একবার নষ্ট হওয়ার পর আর করে ওঠা সম্ভব হয়নি, রাত্রিবাসের বেশ ভালো ব্যাবস্থা রয়েছে, মূলত বিভিন্ন কর্মশালায় বাইরে থেকে গেস্ট ফ্যাকাল্টি আসলে বা ছেলেমেয়েরা থাকলে গুরুকূল এবং গেস্টরুম মিলিয়ে ভালোভাবেই থাকবার ব্যবস্থা করা হয় এবং গুরুকূলে রীতিমত ক্যান্টিন সিস্টেম চলে সুতরাং অতিথিদের জন্য খাওয়ার সুব্যাবস্থা আছে। শুধু চা ছাড়া এখানে প্রায় সব নেশার দ্রব্য বর্জনীয়’ বলে জানালেন শুভেন্দু – ঋতুপর্ণা।
জিজ্ঞেস করলাম আগামীদিনের স্বপ্ন কি?
হাসলেন ঋতুপর্ণা। ‘গুরুকূল গড়ে ওঠার গল্পতো আগেই বললাম, ধাপেধাপে এগোনোর গল্প এবারে বলি। (এক মায়াময় টিলার মধ্যে ঢুকে পড়লেন তিনি, তার চোখের মধ্যে দিয়ে আমিও ঢুকে পড়লাম) উদ্বোধনের দিন প্রচুর দর্শক, তখন শুধু মাথার ওপর চালা, তিন পাশে চটের পর্দা দিয়ে ঘিরে। শো শুরু হয়েছিল, কারেন্ট ছিলনা। জেনারেটের ভাড়া করে অনুষ্ঠান, আশাতীত দর্শক হয়েছিল। দলের সবাই মিলে ঠিক হলো যদি প্রত্যেক মাসে শো করা যায়, কেমন হবে? নাম দেওয়া হল হট্টমেলা, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল কথক পারফর্মিং রেপার্টারি, বাউরিয়া পিপলস রেপার্টারি থিয়েটার, চেনা আধুলি, গোবরডাঙ্গা স্বপ্নচর, উত্তরপাড়া ব্রাত্যজন, চাকদহ নাট্যজন, অশিক্ষিত, বালার্ক, পুনে আরতি তিওয়ারি, ঢাকা শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র, বিসর্গ, বাকসা ব্রাত্য নাট্যজন, সবার পথ, নিষাদ পরিবার, হাওড়া থিয়েটারস্ ওয়ার্কার রেপার্টারি প্রমুখ দল। এরা যদি সঙ্গে না থাকত তাহলে প্রতিমাসে হট্টমেলা করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। কিন্তু শোয়ের পর সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া, প্রচুর শ্রম ও চিন্তা সারাক্ষণ জুড়ে থাকে এই কাজে। আমরা এই কাজে নিয়মিত না থাকলে গরু, ছাগল মানুষ চালার নীচে তাদের নানান অপকর্ম সব করে রেখে যেত, মদ খেয়ে ভাঙা বোতল ফেলে যেত, কতোবার আমাদের, বাচ্ছাদের হাত পা কেটে গেছে, ভাঙা বোতলে তার ইয়ত্তা নেই। আমরা ২ফুট পর্যন্ত বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিলাম, তখন সরকার থেকে একটা বাথরুম করে দিয়েছিল, মূলত সেখানেই জিনিস রেখে দরজা আটকে আমরা চলে আসতাম। ব্রাজিল থেকে মারিলিনি নুন্স তখন এসেছিল কলকাতায় আমাদের দুদিনের কর্মশালা করালো, মুস্কিল হল ডেকরেট করে রেখে সারা রাত একলা ছেড়ে দেওয়া যায়না, রাতে ওখানে পালা করে থাকতে শুরু করলাম। চারপাশে শুধু চটের পর্দা, ঠান্ডায় খুব কষ্ট হত, সহ্যের বাইরে, সবার মনে হল একটা ঘরের প্রয়োজন। বাথরুমের জন্য জলের প্রয়োজন, কুয়ো খোঁড়া হলো। উত্তর দিকে মাটির ঘর বানানো হলো, দর্শক বাড়তে শুরু করল। কিন্তু তার সঙ্গে যেটা বাড়ছিল বাচ্ছা বাচ্ছা মেয়েদের জন্য উদ্যোগ। রিহার্সালের জায়গা চারপাশটা খোলা, চটের পর্দা রিহার্সালের সময় প্রতিদিন টাঙাও, খোলো, রিহার্সালের অর্ধেক সময় সেখানেই চলে যেত। ঠিক হলো একটু একটু করে ঘেরা হবে বেড়া দিয়ে। শুভাদি এলেন নাচের কর্মশালা করাতে, প্রচন্ড বৃষ্টি, অনুষ্ঠান ভালোভাবেই হলো। কিন্তু সমস্যা হলো খাবারের এবং রিহার্সালের, সময়তেও দিনে মাথার উপর সূর্য। গরমে খোলা আকাশের নীচে চলছে রান্না তাও আবার কাঠের জ্বালে। এর মধ্যে কারেন্ট চলে এসেছে, সবাই ঠিক করল, রান্নাঘর করা হোক। পূর্ব দিকে তৈরি হলো রান্নাঘর। ধীরে ধীরে গুরুকূল নিজের আকার পেতে শুরু করল। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির আর্থিক সাহায্য না পেলে এই আকার আমাদের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি করে দেওয়া সম্ভব হতনা। তার মধ্যে জৈব পদ্ধতিতে চাষে প্রায় ৬/৭ মাসের চালের জোগান আসতে শুরু করল। বিভিন্ন শাকসব্জি আয় দিতে শুরু করল। বেশ চলছিল, ছেলেমেয়েদের থাকার প্রয়োজনে পূর্ব দিকে বেড়া কাঠ দিয়ে একটা ঘর, একটা স্টোররুম তৈরি হলো। মাটির ঘরের সঙ্গে সংলগ্ন বাথরুম হলো, সাবিত্রীবাই ফুলে নাট্য-এর শুরুতে সুষমা দেশপান্ডে ম্যাম এসেছিলেন, তিনিও আমাদের এই গেস্ট রুমে থেকেছেন। পুকুরে চাষ হতে শুরু করল। স্বপ্ন এভাবেই বাস্তবে রূপ পাচ্ছিল কিন্তু গত বছরের আম্ফান গুরুকূলের স্ট্রাকচার ছাড়া বাকি সব ভেঙে তছনছ করে দিল। তবু বহু মানুষ সাহায্য করল বলে আমরা এল- শেপে উত্তর পূর্বদিকে জুড়ে ইটের দালান গড়ে তোলা হলো। কিচেন কাম ক্যান্টিন, কম্পিউটার রুম, লাইব্রেরি রুম, মুক্ত মঞ্চ, একটা বড় ডাইনিং স্পেস তৈরি হল কিন্তু আবার এবারের বন্যা আবারও বেশ বড়সর একটা আঘাত দিয়ে থমকে দিল।’ এভাবেই নানান ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে আমতা পরিচয়।
প্রতিকূলতাকে জয় করাই যাদের নৈমিত্তিক একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু পরিচয়ের পরিচয় গ্রাম-পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে তাই মোটামুটি শুরুর দিন থেকেই অনেক মানুষ এসেছিলেন এখানে, ২০০র উপর, ৫০ জনের সিট, বাকি মানুষ দাঁড়িয়ে দেখেছেন। অনেকবার হয়েছে এমন, ভাঁটা পরেনি তা নয় , আগের মাসের নাটক ভালো লাগেনি তো পরের মাসে লোক কমেছে, আবার আগের মাসে এত লোক হয়েছে, পরের মাসে প্রচার এই যাননি তারা, লোক কমেছে, কিন্তু গড়ে লোক ভালোই হয়েছে সবসময়।
শুভেন্দু বল্লেন, ‘গুরুকূলকে ঘিরে প্রায় ৫টা গ্রাম, ফলত আমরা একটু জানান দিলেই অনেক দর্শক হয়ে যায়, এমনকি কতবার হয়েছে দর্শক ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। কোভিড সময়, গতবছর তো সেই কারণেই টিকিট সিস্টেম করলাম, ১০০টাকা করে টিকিট, ২টো নাটক, খুব কম করে ২০জন বসাবো, যাতে দূরত্ব রেখে বসানো যায়, তাও লোক ফেরাতে হয়েছে। তবে এই বছর একদমই বসে গেলাম। তবে আবার শুরু করতে হবে, বহু মানুষ গুরুকূলের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মনে হয়তো নেতিবাচক ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তবে এটাও নিশ্চিত, আবার যেদিন শুরু করব আবার লোক অনেক হবে। হবেই। ‘
শুভেন্দুর কন্ঠস্বরে কাঠিন্য তীব্র হয়। এখনও পর্যন্ত এখানে ২০টার ওপর দল পারফর্ম করেছে। এনাদের ভবিষ্যতের ইচ্ছে নিয়মিত এবং পরীক্ষামূলক বিভিন্ন নাটকের কাজের মধ্যে দিয়ে গুরুকূলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এক নতুন ভোরের দিকে।