শিশুর জগৎ রোমাঞ্চ আর কল্পনাতে ভরা শিশুরাইতো বইছে দেশ আর জাতির তারাইতো পরম্পরা।।
অন্নদাশংকর রায় সেই কবেই তো লিখে গেছেন – “তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো, তোমরা যেসব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো !– তার বেলা?”
আমরা যারা আদ্দামরার দল, গোঁফ-দাড়ি গজাতে না গজাতেই নিজেদেরকে একটা বেশ ‘বড় ইয়ে’ গোছের ভাবতে থাকি, তারপর যত দিন যায় নিজেদের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো ভুলতে থাকি ভুলতেই থাকি, পারিপার্শ্বিক অবস্থান খানিকটা বাধ্য করে ফেলে আসা অতীতকে ভুলে যেতে। পিটুইটারির ক্ষরণ যত বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে তত ফিকে হতে থাকে শৈশবের স্মৃতি। ‘বড়’ হয়ে ওঠার তাগিদেই বোধহয় ছোটদের ওপর চাপিয়ে দিই শুধু না! – এটা করো না, ওটা করো না, সেটা করতে নেই, অমুকটা ভালো না তুশুকটা খারাপ… আরোও কত কি! আসলে জীবনের চলনে নিয়মের নাস্তিতে সবটাই স্বাভাবিক। তবে, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, যে সব ‘বুড়োদের’ মধ্যেই একটা করে শিশু থাকে, কারও মধ্যে অতি জাগ্রত কারোর মধ্যে বা কিঞ্চিৎ নিদ্রিত অবস্থায় থাকে। একটু সুযোগ পেলেই শিশুগুলো বেরিয়ে এসে শুরু করে তাদের বিচরণ। আর বড়দের মধ্যে শিশুর সারল্যমাখা লুটোপুটি দেখতে আমার দারুণ লাগে। তা সে যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক, কিন্তু ‘সমাজ’ নামক রাষ্ট্রিক কাঠামোয় তা অধিকাংশ সময়ই ঠিক খাপ খায়না, তখনই শুরু হয় দ্বন্দ্ব ! আর এই দ্বন্দ্বকে ছান্দিক করে কাটা ছেড়া করে রং-চং মাখিয়ে সাজিয়ে তুলতে আমার দারুণ লাগে। আমার কর্মক্ষেত্র থিয়েটার, তাই থিয়েটারের মধ্যেই খুঁজতে থাকি অঙ্গে লেগে থাকা শৈশবের সারল্যকে। এমনটা নয় যে আমি বা আমাদের দল থিয়েলাইট শুধু শিশু নাটকই করি –না না কক্ষনো না। আমাদের আদ্দামরা ‘বড়’দের দল, এই একুশ বছরের পথ চলায় নাট্যের বিভিন্ন ডালে লাফালাফি করলেও মাঝে মাঝেই হানা দিয়েছি বাংলা শিশু সাহিত্যের আঁতুর ঘরে। বড়দের দিয়ে ছোটদের নাটক করা বা বলা ভালো ছোটদের কথা বলার মধ্যে দিয়ে আমি বারবার ফিরতে চেয়েছি আমার শৈশবে যেখানে একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে অপেক্ষা করে আমার জন্যে, অপেক্ষা করে আমায় নিয়ে বেড়িয়ে আসবে ব্যাঙ্গমা-ব্যঙ্গমীদের দেশে। যেখানে লালকমল-নীলকমল, বুদ্ধুভুতুমরা মেঘের কোলে খেলে চলেছে ডাংগুলি বা দারিয়াবান্দা বা কানামাছি!
আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার এত সমৃদ্ধ ও সুবিশাল তাতে এক জীবনে তার এক আঁচলাও কাঁচানো শুধু দুরূহই নয় এক কথায় অসম্ভব! আর যেহেতু আমার কাছে বড়দের ছোট হয়ে ওঠার চেষ্টা আর নাচেষ্টার দ্বন্দটা বেশ উপভোগ্যের তাই ফিরে ফিরে আশ্রয় নিয়েছি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার থেকে উপেন্দ্রকিশোর হয়ে সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা রবীন্দ্রনাথের পদতলে। রূপকথার আবডালে নীতিশিক্ষা শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলে এমনকি বড়দেরও করে তোলে স্মৃতিমেদুর।
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের অমর শিশু সাহিত্য ঠাকুরমার ঝুলির মঞ্চরূপ করতে গিয়ে দেখেছি প্রবীণ দর্শককুলের শৈশবের সারল্যমাখা হুটোপুটি। তাঁদের প্রতিটি অভিব্যক্তি আমাকে বাধ্য করেছে বারবার রূপকথার মহাসাগরে সাঁতার কাটতে। একই সঙ্গে অভিনেতারাও ফিরে পেয়েছে শৈশবত্তীর্ণ প্রাক কৈশোরের আমোদিত বিকেলগুলো। সত্যি সত্যিই থিয়েটার হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। আবোল তাবোলে ভরা শিশু মনস্তত্ত্ব, ওখানেই লুক্কায়িত আমাদের জিয়নকাঠি। যার স্পর্শে আবালবৃদ্ধবনিতা খুঁজে পায় প্রাণের স্পন্দন, মুক্তির খেলা ঘর।
ফেলে আসা বিকেলগুলো আমায় বড় টানে। মধ্য চল্লিশের কূটনৈতিক খেয়ালিপনার মায়াজাল ছিঁড়ে দৌড়তে ইচ্ছে করে হেমন্তের সেই গোধূলিগুলোতে যেখানে গোলাপি আর কমলা মিশে গিয়ে ধূসর হত না, সাপ বাজির গন্ধে ব্যাকরণ কৌমদির মলাটের আড়ালে থাকত হাদা-ভোঁদা নন্টে-ফন্টে বা পাণ্ডব গোয়েন্দা। অপেক্ষার নিরসন ঘটিয়ে লোডশেডিং এর আলোয় লুকোচুরি আর ধাপ্পা ধাপ্পা খেলা !
মহামারীর অছিলায় বন্ধ থাকা স্কুল আর বাবা-মা ও আমি’র সংসারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা, এসময়ের মহার্ঘ্য অস্ত্র সেলফোন থেকে খানিক বিরতি দিতে –উঁহু বিরতি নিতে আবারও আশ্রয় নেব ওইসব শিশু সাহিত্যের অমর স্রষ্টাদের চরণে, যাঁরা ঘন তমসায় পথ চিনিয়ে দেয় সঠিক গন্তব্যের।